আপনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট পড়লে দেখবেন—সেখানকার সবকিছু ইহুদি জাতি আর পবিত্রভূমির ব্যাপারে ইহুদিদের সাথে আল্লাহর কৃত ওয়াদা তথা কোভেনেন্টকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়! অর্থাৎ ইহুদিদের সমস্ত ধর্মীয় ইতিহাসের উত্থান-পতন অনেকটাই পবিত্রভূমি আর টেম্পল-মাউন্ট কেন্দ্রিক। আল্লাহর সাথে ইহুদিজাতির চুক্তি মোতাবেক আল্লাহ ইহুদিদের পবিত্রভূমিতে কর্তৃত্ব দান করেন; আবার ইহুদিরা চুক্তি ভঙ্গ করলে (অর্থাৎ আল্লাহর অবাধ্য হলে) আল্লাহ তাদের কাছ থেকে পবিত্রভূমি কেড়ে নেন। তাদের বিজাতীয়দের কাছে পদানত করেন। বিজাতীয়দের অধীনস্থ দাস বানিয়ে দেন। এভাবেই আল্লাহ পুরো ওল্ড টেস্টামেন্ট জুড়ে বনি ইসরাইলকে রক্ষা করেন, পুরস্কৃত করেন এবং শাস্তি দেন।
ইসলাম গ্রহণের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুহাম্মাদ আসাদ (প্রাক্তন ইহুদি সাংবাদিক) বলেছিলেন—ওল্ড টেস্টামেন্ট আর তালমুদ পড়লে আল্লাহকে নিছকই কোনো গোত্রীয় দেবতা মনে হয়—যিনি শুধুমাত্র ইহুদি জাতির ভাগ্য নিয়েই চিন্তিত, অন্যসব জাতি নিয়ে ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং তালমুদের আল্লাহ অনেকটাই বেখবর।

ইহুদিরা নবী মুহাম্মদ (স)-কে কেন নবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় নি—তার কারণ আমি খোঁজার চেষ্টা করেছি। সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর না পেলেও ভিন্ন ভিন্ন ইহুদি গ্রুপের কিছু ভিন্নভিন্ন উত্তর পেয়েছি। এখানে সে উত্তরগুলো টুকে রাখছি।
১. নন জুইশ কোনো নবীর প্রতি ইমান আনা ইহুদিদের জন্য নিষিদ্ধ।
২. সেকেন্ড টেম্পল ধ্বংসের সাথেসাথেই নবীদের যুগ শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং নতুন কোনো নবীর আগমন হবে না।
৩. নবী দাবিদারদের যারা ভেরিফাই করতো—সেই সানহেন্দ্রিন কাউন্সিলের কোনো সর্বসম্মত কাঠামো বর্তমানে নেই। সুতরাং, নতুন কোনো নবীর দাবিদারকে ভেরিফাই করা সম্ভব নয়।
৪. একজন নবী দাবীদার কখনোই তোরাহর শরিয়তকে পরিবর্তনের চেষ্টা করবে না। তোরাহর শরিয়তের থেকে ভিন্ন নতুন কোনো শরিয়তের দাবিদার নিঃসন্দেহে মিথ্যা নবী। মুহাম্মাদ (স) যেহেতু সাব্বাত দিবস, কিবলাহ সহ মুসা (আ)-এর শরিয়তের অনেক কিছুই পরিবর্তন করেছেন—ফলে কিছু ইহুদি পন্ডিতের মতে তিনি নিঃসন্দেহে মিথ্যা নবী।
৫. কিছুকিছু ইহুদি পন্ডিতের মতে মুহাম্মদ (স) নবী হতে পারেন। তবে তিনি যদি নবী হয়েও থাকেন—তিনি কেবলই জেন্টাইলদের নবী। তাঁকে নবী হিসেবে মেনে নেয়া ইহুদিদের জন্য অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
উল্লেখ্য, বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের বুক অব আইজায়াতে বেশকিছু প্রফেসি আছে ভবিষ্যৎ নবী সম্পর্কে। অনেক মুসলিম পন্ডিত মনে করেন সেখানে নবী মুহাম্মদ (স)-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। ইহুদিদের কিছু গোত্র আরবে নতুন নবীর আবির্ভাবের সম্ভাবনা থেকে মদীনায় এসে বসবাস করা শুরু করে বলে কথিত আছে; অবশ্য ইহুদি সোর্স থেকে এ সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না।
আবার যদি নিউ টেস্টামেন্ট পড়েন, দেখবেন—সেখানকার সকল ন্যারেটিভ একটি জাতিগোষ্ঠীর বদলে বরং একজন মানুষকেন্দ্রিক; এই ন্যারেটিভটি সম্পূর্ণভাবে একজন নবী (তাদের মতে ঈশ্বরের পুত্র, অথবা স্বয়ং ঈশ্বর) আর মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে তার ক্রুশবিদ্ধ হওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ যীশু হলেন এক মেষশাবক, যিনি মানবতার পাপ মোছনের উদ্দেশ্যে নিজেকে কুরবানী করেন। খ্রিস্টানদের ন্যারেটিভে ধর্ম তাই একজন ব্যক্তি মানুষের সেক্রিফাইসকে কেন্দ্র করে যে প্রচন্ড আবেগ তৈরি হয়েছে—সেটাকে পুঁজি করে আবর্তিত হয়েছে। একসময় যীশু তাদের বিশ্বাসে কালক্রমে ঈশ্বরের পুত্র অথবা স্বয়ং ঈশ্বর হয়ে ওঠেন। তাই ইহুদিদের ‘মনোনীত জাতি’ এবং ‘পবিত্রভূমির মালিকানার ঐশ্বরিক চুক্তি’ কেন্দ্রিক ন্যারেটিভের পরিবর্তে খ্রিস্টানদের ন্যারেটিভে সমস্ত ফ্যাসিনেশন যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়া নিয়ে; পবিত্রভূমির অধিকার নিয়ে খ্রিস্টানদের তেমন একটা ফ্যাসিনেশন নেই। খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী ‘সিটি অব গড’-এর অবস্থান হলো খ্রিস্টকে ঈশ্বর পুত্র ও পরিত্রাতা হিসেবে যারা বিশ্বাস করেন—তাদের অন্তরে।
ইহুদি ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি তাদের এস্কেটোলজিও তৈরি হয়েছে পবিত্রভূমিতে ইহুদিদের ঈশ্বরপ্রদত্ত মালিকানার ন্যারেটিভকে কেন্দ্র করে। তাদের বিশ্বাসে মেসায়াহর ভূমিকাও নিছকই ইহুদিজাতী আর পবিত্রভূমিকে ঘিরে আবর্তিত। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী মেসায়াহ হবেন কিং ডেভিডের মতো শক্তিমান ইহুদি শাসক—যিনি থার্ড টেম্পল থেকে পুরো জাতির নেতৃত্ব দেবেন। ঈসা (আ) বা যীশু যেহেতু শাসক টাইপ কেউ ছিলেন না—তাই তাঁকে মাসীহ বা মেসায়াহ হিসেবে স্বীকার করে না।
ইহুদিরা মনে করে—তারা আল্লাহর ‘মনোনীত জাতি’, আর মনোনীত অর্থে তারা সবাই ঈশ্বরের সন্তান। অন্য জাতির নবী কিম্বা জেন্টাইলদের নবীর প্রতি ঈমান আনাকে তারা নিজেদের জন্য নিষিদ্ধ মনে করে। এ ছাড়াও ইহুদিরা মনে করে—সেকেন্ড টেম্পল ধ্বংসের সাথেসাথে নবীদের যুগ শেষ হয়ে গেছে; মদিনার ইহুদিরা তাই মুহাম্মাদ (স)-কে নবী হিসেবে মেনে নেয় নি। এই ব্যাপারে একজন ইহুদি রাবাইয়ের একটা ভিডিওর লিংক দিচ্ছি— https://fb.watch/cwZ-mULM4J/
অন্যদিকে ইভাঞ্জেলিকাল খ্রিস্টান এস্কেটোলজি অনুযায়ী—যীশু ফিরে আসবেন জেরুজালেমে, আর তাঁর ফিরে আসা যাতে দ্রুত হয়—সেই লক্ষ্যে ইভাঞ্জেলিকাল খ্রিস্টানরা ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্রের সমস্ত কর্মকাণ্ডকে চোখ বন্ধ করে সমর্থন করে। তারা মনে করে—জেরুজালেমে ইহুদিদের পুনর্বাসনই যীশুর আগমনকে তরান্বিত করবে। এই বিশ্বাসের কারণে এক অর্থে ইভাঞ্জেলিকাল খ্রিস্টানরাও জায়োনিস্ট।
বাইবেল, ইহুদিজাতির ইতিহাস আর ইসলামের ইতিহাস নিয়ে পড়তে গিয়ে কিছু অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। ইহুদিদের বিশ্বাসের সাথে মুসলিম সুন্নি বিশ্বাসের যেমন অদ্ভুত মিল পেয়েছি—তেমনি খ্রিস্টানদের সাথে অদ্ভুত মিল রয়েছে শিয়া মুসলিমদের বিশ্বাসে। ইহুদিরা তাদের আইনশাস্ত্র এবং শরীয়াহকে (ইহুদি ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী) সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেয়, যেমনটা সুন্নি মুসলিমদের ক্ষেত্রে দেখা যায়; সুন্নি মুসলিমদের কাছে আহলে বাইতের ব্যক্তি বিশেষের খুব একটা গুরুত্ব নেই, বরং সমস্ত আসহাবে রাসূলরাই সম্মানিত। নিজস্ব ট্রেডিশন আর উম্মাহ চেতনা সুন্নিদের মধ্যে বেশ প্রখর, যেমনটা ইহুদের ধর্মতত্ত্ব আর জাতীয়তাবাদী প্রবণতার ক্ষেত্রে দেখা যায়! সুন্নিদের কাছে ধর্মীয় আবেগের থেকে ধর্মীয় বিধান বেশি গুরুত্ব পায়; ইহুদিদের কাছেও ঠিক তাই।
অন্যদিকে, ইমাম হুসাইনের কারবালার প্রান্তরের শাহাদাতকে কেন্দ্র করে (অনেকটা খ্রিস্টানদের মতোই) শিয়া মুসলিমদের মাঝে প্রচন্ড ভাবাবেগ তৈরি হয়েছে। উম্মাহ চেতনার চাইতে বেশি ‘আহলুল বাইতের চেতনা’য় শিয়ারা আচ্ছন্ন হয়েছে। শুরুর দিকে খ্রিষ্টের অনুসারী হিসেবে ইহুদিদের মধ্যকার একটা ফিরকা নিজেদের পরিচিত করতে যেমন ‘খ্রিস্টান’ বা ‘খ্রিস্টের অনুসারী’ নাম গ্রহণ করে নিয়েছিলো—ঠিক তেমনি শিয়ারাও আলী (রা)—এর অনুসারী দাবী করে নিজেদের নামকরণ করেছে ‘শিয়াতু আলী’ বা ‘আলীর দল’। খ্রিস্টানদের মতো শিয়াদের কাছেও ধর্মীয় বিধানের চাইতে ধর্মীয় আবেগই গুরুত্ব পায় বেশি। আবেগের আতিশয্যে খ্রিস্টানরা নবী ঈসাকে যেমন অতিমানবীয় করে তুলেছিলো—তেমননি শিয়ারা হয়রত আলী, ইমাম হুসাইন তথা তাদের অন্যান্য ইমামদের করে তুলেছে অতিমানবীয়। খ্রিস্টান আর শিয়াদের বিশাল সংখ্যক অংশের মধ্যেই বিভিন্ন বুজুর্গদের মাজার পূজা করার প্রবণতা দেখা যায়। খ্রিস্টান ও শিয়া—উভয়ের মাঝেই শির্ক বিদআতের ছড়াছড়ি পরিলক্ষিত হয়।
আল্লাহ ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের ধর্মচ্যুতির ইতিহাসকে মুসলিমদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে রেখেছেন। ইহুদিরা কোন অর্থে অভিশপ্ত আর খ্রিস্টানরা কোন অর্থে পথভ্রষ্ট—এ ব্যাপারে মুসলিমদের গভীরভাবে চিন্তা করাটা জরুরি। মুসলিমরা ইহুদিদের মতো শরীয়ত নিয়ে বাড়াবাড়ি আর খ্রিস্টানদের মতো ছাড়াছাড়িতে বিশ্বাসী নয়। আবার অন্যদিকে মুসলিমরা ধর্মীয় আবেগের ব্যাপারে খ্রিস্টানদের মতো বাড়াবাড়ি এবং ইহুদিদের মতো ছাড়াছাড়িতেও বিশ্বাসী নয়। আল্লাহ মুসলিমদের করেছেন উম্মাতু ওয়াসাতা, অর্থাৎ মধ্যমপন্থী জাতি। অথচ মুসলিম সুন্নি ও শিয়াদের একটা বড় অংশই বেশ সচেতনভাবে ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের মতো প্রান্তিকতায় লিপ্ত হয়েছে।
আমরা দুআ করি, আল্লাহ যেন আমাদের নবী-রাসূলদের পথে অটল রাখেন; ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের অনুসৃত প্রান্তিকতা থেকে আমরা আল্লাহর কাছে পানাহ চাই—
“(ইয়া আল্লাহ), আমাদেরকে সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। তাদের পথ, যাদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করেছেন। তাদের পথে নয়, যাদের প্রতি আপনার গযব বর্ষিত হয়েছে, তাদের পথও নয় যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। আমীন!!” [সুরা ফাতিহা]
পরিশেষে একটা কথা বলি, ইহুদি আর খ্রিস্টান ধর্মের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস পড়লে বোঝা যায়—ইসলাম এ দুটো ধর্মের তুলনায় কতটা যুক্তিপূর্ণ, ভারসাম্যপূর্ণ, প্রশস্ত আর বৈশ্বিক! তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়লে এমনিতেই ঈমান বেড়ে যায়। মুহাম্মাদ আসাদ তার ইসলাম গ্রহণের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন—ইসলাম যেন এক নিখুঁত আর্কিটেকচার… যেন যেখানে যা থাকা দরকার- ইসলাম ঠিক সেভাবেই সাজানো। অর্থাৎ একশব্দে ‘পার্ফেক্ট’।
আচ্ছা, একজন মুসলিম হিসেবে আপনি কি কখনো ইসলামের এই পার্ফেক্টনেস সম্পর্কে ভেবে দেখেছেন? করেছেন শিকড়ের সন্ধান?