সাজিদ ভাই

সাজিদ ভাই আমার পছন্দের একজন মানুষ। আমার জীবনে দেখা অসম্ভব ট্যালেন্টেড মানুষদের একজন সাজিদ ভাই। ভার্সিটি লাইফে সাজিদ ভাই অনেক প্রাণোচ্ছল আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। তিনি এখনো কমবেশি আড্ডাবাজ। ওনার গানের গলা অসম্ভব ভালো। একসময় খালিদ, নচিকেতাসহ অসংখ্য জীবনবাদী শিল্পির গান সাজিদ ভাইয়ের মুখেমুখে থাকতো। 

ভার্সিটি লাইফ শেষ হবার পরেও ফেসবুকে ভাইয়ের সাথে টুকটাক আলাপ হতো। বেশ কিছুদিন তিনি কিছু সমস্যায় ভোগা শুরু করলেন। তখন আমাকে মাঝেমধ্যেই কল দিতেন, বিভিন্ন প্রশ্ন করতেন। সাজিদ ভাইয়ের কাছে মনে হতো—ইসলাম পালন অনেক কঠিন ব্যাপার; পাপীদের ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহর অবস্থান ওনার কাছে অনেক কঠোর মনে হতো। সাজিদ ভাইকে আমি বিভিন্নভাবে বোঝানোর ট্রাই করতাম—কিন্তু ওনাকে স্ট্যাটিসফাই করাটা ছিলো অনেক মুসকিলের কাজ।

সাজিদ ভাই আমার রেকমেন্ডেশন অনুযায়ী টুকটাক কিছু বইও পড়া শুরু করলেন। এরপর একবার ছুটি নিয়ে আমি চাঁদপুর ওনার কাছে বেড়াতে গেলাম। সাজিদ ভাই আমাকে ওনার জীবনের গল্প বললো। একসাথে দুজনে খালিদ-নচিকেতার গানও গাইলাম। সাজিদভাই যখন গান গাচ্ছিলেন—ওনাকে অনেক সুখী মনে হচ্ছিলো। একবার উনি নাকি লালনের আখড়ায় গেলেন, সেই গল্পও করলেন।

সাজিদ ভাই বললেন—’জানো জাহিদ, আমি যখন প্রাণখুলে গান গাই, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিই—তখন আমি অনেক ভালো অনুভব করি, কিন্তু একই সাথে তখনই আমার কাছে ইসলামকে অনেক কঠিন মনে হতে থাকে। গান শুনলে বা গাইলে অন্তরে একসময় কেমন যেন হাহাকার অনুভূতি জাগে। তখন ধর্মীয় বিশ্বাস, নামাজ-কালাম ইত্যাদির প্রতি মনে একধরণের সংশয় অনুভূত হতে থাকে।’ 

আমি সাজিদ ভাইকে প্রশ্ন করি—’আপনি যখন ইসলামিক নাশিদ শোনেন বা নিজেই গান—তখনও কি একই অনুভূতি হয়?’ সাজিদ ভাই বললেন—’না, তখন হয় না।’

আমি বোধহয় সমস্যাটা এবার কিছুটা ধরতে পেরেছি।

গানের কথাগুলো মানুষের অন্তরে শক্তিশালী প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। মিউজিক অন্তরে এক অদ্ভুত উন্মাদনার জন্ম দেয়; সুরের এক পরাবাস্তব জগতে একজন শিল্পী বা শ্রোতা বুধ হয়ে থাকে। মিউজিকের কথাগুলো ইহজাগতিকতাকে মানুষের অন্তরে ইনডক্ট্রিনেইট করে। গান শুধুই অর্থহীন কিছু কথা নয়, বরং একটা জীবনবোধকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক; লালনের একটা বিখ্যাত গান আছে—

“এমন মানবজনম আর কী হবে

মন যা চায় তরাই করো এই ভবে!”

ইহজাগতিক এইসব গানের সাথে ইসলামের তেমন কোনো রেলেভেন্সি খুঁজে পাওয়া যায় না। আর ঠিক তখনই ইসলামকে কঠিন মনে হওয়া শুরু হয়, ইসলামের বিধানগুলোকেও কঠোর মনে হতে থাকে। শুধু গানই নয়, মানুষের মনোজগতকে আলোড়িত করতে পারে—এমন যেকোনো সেক্যুলার আর্টের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা কম-বেশি সত্য।

আমরা যখন নিবিড়ভাবে কুরআন-সুন্নাহ পড়ি এবং আমলের চেষ্টায় রত থাকি—তখন কিন্তু ইসলামকে অতটা কঠিন মনে হয় না। কিন্তু যখন দুনিয়াকে বুঝতে চাই, জাগতিক আদর্শগুলোকে আত্মস্থ করা শুরু করি—তখনই ইসলাম আমাদের কাছে কঠিন মনে হতে শুরু করে। ইসলাম যদিও দুনিয়া ও আখিরাতকে ব্যালেন্স করে—তবু ইসলামের ঝোঁক সর্বদাই আখিরাতমুখী। আর অন্যদিকে সেক্যুলারিজমে দুনিয়াই সব। এই দোটানাই একজন আধুনিক বিশ্বাসী মানুষের অন্তরকে সারাক্ষণ অস্থির করে রাখে। এই অস্থিরতাই তাকে সংশয়বাদের দিকে নিয়ে যায়।

মিউজিক মানুষের অন্তরে যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে—যার ফলে ইসলামকেই আমাদের কাছে কঠিন মন হওয়া শুরু হয়—সেই মিউজিককেই আমাদের কেউকেউ ইসলামাইজ করার চেষ্টা শুরু করেন। শুধু মিউজিকই নয়, সম্ভবত গোটা ইসলামাইজেশন প্রজেক্টের গলদটা এখানেই। নিজের নাফসানিয়াতের তাড়নায় কঠিন মনে হওয়া ইসলামকে সহজ করতে গিয়ে আমরা আরো বেশি ধোঁয়াশাপূর্ণ এবং জটিল করে তুলি, মনের অজান্তেই।

ইসলামের একদম মৌলিক আকিদা-বিশ্বাসগুলো অনুধাবন এবং সেই অনুযায়ী ইহসানের সাথে যদি আমরা আমল করতাম—তবে ইসলামকে কখনোই আমাদের এতটা কঠিন মনে হতো না। এতটা কঠোর মনে হতো না ইসলামের বিধানগুলোকেও। ইসলাম আমাদের অন্তরে কী ধরণের জীবনবোধ তৈরি করতে চায়—তা বুঝতে হলে আমাদের বেশিবেশি কুরআন, হাদীস, সীরাহ এবং ইসলামের ব্যাপারে সাহাবী, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈন ও ইমামদের আন্ডার্স্ট্যান্ডিং সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ও বোঝাপড়া থাকার কোনো বিকল্প নেই। 

২.

সাজিদ ভাইকে আমি মোজাম্মেল স্যারের সাথে ওনার সমস্যাগুলোর ব্যাপারে কথা বলতে বলি। সাজিদ ভাই স্যারের সাথে কথা বলার পর ওনার অনেক কনসেপ্টই ক্লিয়ার হয়। এরপর ড্যানিয়েল হাকিকাতযুর ‘সংশয়বাদী’ বইটা পড়ার পর—উনি ওনার প্রশ্ন আর সংশয়ের শেকড় সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারেন। আমি বিশ্বাস করি, ওহির জ্ঞানের পাশাপাশি যুক্তিবুদ্ধির মাধ্যমেও সত্যকে বোঝা সম্ভব, যদি বিবেক স্বচ্ছ থাকে, কান্ডজ্ঞান পরিস্কার থাকে। আর এই ব্যাপারে এদেশে বর্তমানে মোজাম্মেল স্যারের চাইতে অন্যকারো ভালো কাজ আছে বলে আমার জানা নেই।

বর্তমানে সাজিদ ভাই তাবলিগ জামাআতের সাথে সফরে আছেন; তাদের সাথে মেশার পর তাবলিগ সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণাও ওনার দূর হয়েছে। একটা নির্দিষ্ট মানহাজ বা পদ্ধতির মানুষের সাথে ঠিকভাবে মিশতে এবং কমিউনিকেট করতে পারলে আসলে তাদের সম্পর্কে অন্তরে তৈরি হওয়া অনেক ভুল ধারণাই দূর হয়ে যায়। ঘৃণা বদলে যায় ভালোবাসায়; জিঘাংসা পরিণত হয় ইহসানে।

ইসলাম সহজ, তাদের জন্যই সহজ—যারা জীবনের প্রকৃত সরূপ সম্পর্কে যথাযথ উপলব্ধি করতে পেরেছেন, যারা সত্যিকার অর্থে ঈমানদার হতে পেরেছেন।

Share On:

Facebook
Twitter
LinkedIn

Related Posts:

হিংসা

দুই বন্ধু বসন্তের কোনো এক সুন্দর সকালে বনে বেড়াতে গেল। চার দিকে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। দুই বন্ধুর মেজাজ তাই বেশ

Read More »

ক্যারিয়ার ও কদর

একটা ঘটনা বলি, আমি একটা নামকরা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ইন্টার্ভিউ দিতে গিয়েছিলাম। সে ইন্টার্ভিউতে একজনের সাথে আমার পরিচয় হয়, যে কিছুদিন

Read More »