এডোয়ার্ড সাঈদ তাঁর ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বইতে দেখিয়েছিলেন যে পাশ্চাত্যের ওরিন্টালিস্টরা কীভাবে প্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি অধ্যয়নের নামে বরং নিজেদের সাংস্কৃতিক সুপিরিয়রিটিকে গ্লোরিফাই করেছিলো। তাদের ওরিয়েন্টালিজম চর্চার মূল বয়ান ছিলো- ‘পাশ্চাত্য কত উন্নত, আর প্রাচ্যের সংস্কৃতি কত নিচু’ তা তাদের নিজেদের জন মানসে স্থাপিত করা। ওরিয়েন্টালিজমের চর্চা প্রথমে শুরু হয় বিভিন্ন ইউরোপিয়ান খ্রিস্টান চার্চের তত্ত্বাবধানে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো ক্রিস্টিয়ানিটির বিপরীতে ইসলাম ধর্ম ও এর প্রচারিত সংস্কৃতি যে কতটা অনৈতিক এবং বর্বর – তা ইউরোপিয় জনমানসে স্থায়ীভাবে গেঁথে দেয়া, আর বিপরীতে খ্রিস্টান সংস্কৃতিকে গ্লোরিফাই করা। ওরিয়েন্টালিজম মূলত পোস্ট ক্রুশেডিয়ান ফেনোমেনা, যা সাংস্কৃতিকভাবে ইউরোপকে জেগে উঠতে ও নিজেদেরকে অন্য সংস্কৃতিগুলোর তুলনায় সুপিরিয়র ভাবতে সাহায্য করেছে।

কালক্রমে ইউরোপ যদিও সেক্যুলার হয়ে ওঠে, কিন্তু তাদের ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের ধরণ খুব একটা পরিবর্তন হয় না। শিল্পবিপ্লবোত্তর ইউরোপীয় পাশ্চাত্য সভ্যতা নিজেদেরকে অন্যান্য সমাজ- সংস্কৃতির চাইতে অধিকতর সভ্য ও উন্নততর ভাবতে শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে তারা পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে নিজেদের কলোনি স্থাপনকে বৈধ মনে করতে শুরু করে। তারা অসভ্য জাতিগুলোকে সভ্য বানানোর মহান(!) দায়িত্বে নিজেদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ধীরেধীরে ইউরোপীয় ভাষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, পলিটিক্যাল ও ইকোনমিক্যাল সিস্টেম বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। ইউরোপিয়ান আদলে শিক্ষা কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশ্চাত্য সভ্যতার বিপরীতে অন্যান্য সব সমাজ ও সংস্কৃতিকে খুবই তুচ্ছ ও নিম্নমানের মনে হতে থাকে। বিজ্ঞানের ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় গ্রিক ও ল্যাতিন, বৈশ্বিক রাজনীতি ও ব্যাবসা- বানিজ্যের ভাষা হয়ে ওঠে ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ ও স্প্যানিশ।
বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারবো আমরা কতটা পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত! আজকাল ভালো চাকরি পেতে হলে ইংরেজিতে ফ্লুয়েন্টলি কথা বলতে পারতে হয়। তাছাড়া আজকাল কথায় কথায় ‘what the fu*k!’ বলতে পারা কিম্বা ‘মিডল ফিঙ্গার’ দেখানোকেও আমরা স্মার্টনেস মনে করি। পাশ্চাত্য রুচির পোশাক, খাবার, আর দৈনন্দিন সাংস্কৃতিক পন্যে আমাদের বাজার ছেয়ে গেছে। প্রাশ্চাত্যের উত্তরসূরী হিশেবে আমরা সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য যেটা পেয়েছি- তা হলো ‘ওরিয়েন্টালিজম’।
এডওয়ার্ড সাঈদ দেখিয়েছেন- বিগত পাশ্চাত্য সমাজ কীভাবে পৃথিবীর অন্যান্য সমাজে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ওরিয়েন্টালিজমের ধারণাকে কাজে লাগিয়েছিলো। তারা নিজেদের গ্লোরিফাই করতো, এবং অন্যান্যদের নৈতিক ও ধারণাগত দিক থেকে ডেমনাইজ ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো! আমাদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে আমরা ওরিয়েন্টালিজমের চর্চা হতে দেখি। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী মতবাদ অন্যান্য ভিন্নমতকে দমন-পীড়নের স্বার্থে সেগুলোকে বিভিন্নভাবে ডেমনাইজ করার মাধ্যমে নিজেরা আরো প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে। ভিন্নমতের উপস্থিতি একধরণের ক্রাইমে পরিণত হয়। এভাবে একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শের লোকজন চায় একধরণের ব্লেইমগেইম এবং রাজনৈতিক শক্তিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে তারা ক্ষমতাশালী হতে। ফলে মতাদর্শিক এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়নের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত দূর্বল মতাদর্শের লোকজন ও সাধারণ জনসমাজ ক্ষমতাশীলদের একান্ত বাধ্য ও অনুগত হয়ে ওঠে।
পৃথিবীর ইতিহাস এভাবেই চলমান থাকে…।