নবিজীবনে রসবোধ ও বিনোদন

মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন মানুষের হিদায়েতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। সর্বশেষ রাসূল হিসেবে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন আরবের বুকে প্রেরণ করেছেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। যিনি ছিলেন আরবের জাহেলি সমাজের বুকে আল্লাহর প্রেরিত নূর, যে নূর ক্রমেই ছড়িয়ে যায় পৃথিবীর দিকেদিকে। মানুষ খুঁজে পায় মুক্তির দিশা, জীবনের ঐশী তাৎপর্য।

আল্লাহ সর্বক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণের মধ্যে রেখেছেন উত্তম আদর্শ। আল্লাহ এ ব্যাপারে কুরআনে বলেছেন-

لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِى رَسُولِ ٱللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُوا۟ ٱللَّهَ وَٱلْيَوْمَ ٱلْءَاخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِيرًا 

অর্থ: তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূলের অনুসরণের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। [সূরা আল আহযাব: ২১]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন মুসলিম হিসেবে, একজন স্বামী হিসেবে, একজন বাবা হিসেবে, একজন নেতা হিসেবে, কিম্বা একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে- সর্বক্ষেত্রেই মানুষের জন্য অনুসরণীয় উত্তম আদর্শ। জীবনের জটিলতা আল্লাহর রাসূল যেমন যাপন করেছেন, তেমনি তিনি উদযাপন করেছেন জীবনের সারল্য। তিনি কোনো জীবন বিমুখ দ্বীন প্রচার করেন নি, বরং ইসলামের রঙে রাঙিয়েছেন জীবনের বৈষয়িক সমস্ত খুটিনাটি উপকরণ। রাসূলের শিক্ষা মানুষের জীবনকে সুন্দর এবং পরিশীলিত করে।

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন ছিলো পরিশীলিত বিনোদন ও অনাবিল রসবোধে ভরপুর। অসুস্থ বিনোদন এবং মানুষকে হেয় প্রতিপন্নকারী তাচ্ছিল্যপূর্ণ কৌতুকের চর্চা থেকে রাসূলুল্লাহ ইসলামের সংস্কৃতিকে পৃথক করেছেন। তাই বলে ইসলাম মোটেই নির্জীব কোনো ধর্ম নয়। ইসলাম মানুষের ধর্মাচার, জীবনবোধ, সংস্কৃতি ও বিনোদনকে আল্লাহর রঙে রাঙাতে চায়।

একদিন কতিপয় নিগ্রো মসজিদে বর্শা নিয়ে খেলছিলো। সেটা দেখে আল্লাহর রাসূল তাদের বললেন ‘খেলো’। অন্য আরেকটি রেওয়াতে আছে- ‘বনি আরফিদা! তোমরা তা গ্রহণ করো। ইহুদি, খ্রিস্টানরা জানুক- আমাদের ধর্মেও বিনোদন আছে।’ 

[সহিহ বুখারি: ৯৫০]

এক ঈদের দিনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়িশা রাদিআল্লাহু আনহা’র কক্ষে শুয়েছিলেন। তাঁর মাথার কাছে দুইজন বালিকা তবলা বাজিয়ে জাহিলি যুগের গান করছিলো। এমন সময় সেখানে আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু আগমন করেন। তিনি তাদের দেখে ধমক দিয়ে বলেন, ‘আল্লাহর রাসূলের ঘরে শয়তানের বাঁশি বাজানো হচ্ছে? তখন আল্লাহর রাসূল তাঁকে বললেন- ‘হে আবু বকর! গাইতে দাও। আজ তো ঈদের দিন।’

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন সময়ে সাহাবীদের সাথে মজা করতেন। কিন্তু সে মজা কিম্বা রসিকতাও কখনো সত্যের সীমা অতিক্রম করতো না। একটা হাদীসে এ প্রসঙ্গে এসেছে, আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত- সাহাবীগণ বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাদের সাথে রসিকতাও করেন। তিনি বলেনঃ আমি সত্য ছাড়া কিছু বলি না। [তিরমিযী, আহমাদ]

একদিন এর কাছে এক বৃদ্ধা মহিলা এসে আল্লাহর রাসূলকে বললেন, ‘আমার জন্য জান্নাতের দুয়া করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মজা করে বললেন- ‘বৃদ্ধারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ মহিলা কান্না করতে করতে ফিরে যেতে লাগলো। তখন আল্লাহর রাসূল হেসে বললেন- ‘তাকে বলো, বৃদ্ধা অবস্থায় জান্নাতে প্রবেশ করবে না। কারণ, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “তাদের আমি উত্তমরূপে সৃষ্টি করেছি, সোহাগী ও সমবয়সি করেছি ডানপন্থি লোকদের জন্য।” 

[সূরা ওয়াকিয়া: ৩৫-৩৭]

একজন মুসলিমের বিনোদন ও রসবোধ কখনোই তার অন্তর থেকে আল্লাহকে ভুলিয়ে দেয় না। বরং মুসলিমের অন্তরের পরিতৃপ্তি তাকে আল্লাহর কথাই বারংবার মনে করিয়ে দেয়। এই ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে পাকে বলেছেন-

قُلْ بِفَضْلِ ٱللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِۦ فَبِذَٰلِكَ فَلْيَفْرَحُوا۟ هُوَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ 

অর্থ: আপনি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ার কথা বলুন। এতেই যেন তারা আনন্দিত হয়। তা-ই তাদের জন্য তাদের জমানো সম্পদের চেয়ে উত্তম। 

[সূরা ইউনুস: ৫৮]

আল্লাহ মানুষের আনন্দের প্রকাশকে পরিশীলিত করতে চান। আর আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে। এমনকি বিজয়ের আনন্দও হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজের পরিবর্তে কতটা চমৎকারভাবে করা যায়- তার শিক্ষাও আমরা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন থেকে পাই। বিজয় অর্জনের পর মুসলিমদের আচরণ কেমন হওয়া উচিৎ, তার শিক্ষা আমরা পাই সূরা নসর থেকে-

‘إِذَا جَآءَ نَصْرُ ٱللَّهِ وَٱلْفَتْحُ 

‘وَرَأَيْتَ ٱلنَّاسَ يَدْخُلُونَ فِى دِينِ ٱللَّهِ أَفْوَاجًا 

‘فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَٱسْتَغْفِرْهُۚ إِنَّهُۥ كَانَ تَوَّابًۢا 

অর্থ: যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়, এবং তুমি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে দেখবে, তখন তুমি তোমার রবের কৃতজ্ঞতা মূলক পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর এবং তাঁর সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা কর; তিনিতো সর্বাপেক্ষা অধিক অনুতাপ গ্রহণকারী। 

মক্কা বিজয়ের আল্লাহর রাসূল মক্কাবাসীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে মহানুভবতার এক অনন্য নজির স্থাপন করেন। তিনি কাফির সম্প্রদায়ের মত্ত হয়ে বিজিত জাতির-গোষ্ঠির প্রতি হত্যা, ধর্ষণ কিম্বা লুটতরাজে মেতে ওঠেন নি। এভাবে রাসূলের শিক্ষা অনুসরণে অসংখ্য মুসলিম বিজয় নিয়ে এসেছিলো ক্ষমার এমন পরিশীলিত আনন্দ। ইসলামের ইতিহাসে আছে এমন অসংখ্য নজির।

হালাল এবং হারাম বিনোদন ও রসবোধের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়ে গেছেন সুস্পষ্ট সীমারেখা। মানুষ তার বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগিয়েও এই হালাল হারাম পার্থক্য করতে পারে।

রাসূলুল্লাহ বলেছেন- ‘হালাল ও হারাম স্পষ্ট। উভয়ের মাঝে কিছু অস্পষ্ট ব্যাপার আছে- অধিকাংশ মানুষই তা জানে না। [সহিহ বুখারি: ৫২]

এ প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরেকটা অনন্য শিক্ষা আছে। এক লোক রাসূলুল্লাহকে পাপ ও ভালো কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন- ‘ভালো কাজ যা হৃদয়কে প্রশান্ত করে, আত্মাকে শান্ত করে। পাপ হলো- যা অন্তরে কালো দাগ ফেলে দেয়, হৃদয়ে দ্বিধা ও সংশয় সৃষ্টি করে। [তাবরানি: ২২]

আমরা হালের নাটক-সিনেমা, অশ্লীল গান-বাদ্য, পর্নোগ্রাফি, ভিডিও গেইম, অহেতুক ঠাট্টা-ট্রলিং ইত্যাদিতে রাতদিন মত্ত থেকেও প্রশান্তি পাই না। প্রশান্তি নামক সুখপাখিটি কোথায় যেন পালিয়ে গেছে। হারাম বিনোদন ও রসিকতা, অশ্লীল কৌতুক, মদ-জুয়া, ইত্যাদি আমাদের অন্তরে কালো দাগ ফেলে দেয়। দ্বিধা ও সংশয় সৃষ্টি করে। এর থেকে যেন মুক্তি মেলে না। 

হ্যাঁ, আমরা একভাবে মুক্তি পেতে পারি। বিনোদন ও রসবোধের চর্চার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কিছু মূলনীতি শিখিয়ে গেছেন। এই মূলনীতিগুলো অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা যেমন পেতে পারি দুনিয়াবি প্রশান্তি, সেই সাথে নিশ্চিত করতে পারি পরকালীন মুক্তি।

Share On:

Facebook
Twitter
LinkedIn

Related Posts:

man looking up at the sky

মুক্তি

পশ্চিমা সভ্যতা হলো মুক্ত পৃথিবী। এই পৃথিবীতে জীবনকে যাপনের জন্য কোনো নৈতিক সীমানা নাই, তাই সীমালঙ্ঘনেরও কোনো বালাই নাই। পশ্চিম

Read More »

‘ইসলামিক’ নাম দেওয়াই কি সার্থকতা?

নামকরণের মাধ্যমে কোনো প্রতিষ্ঠানকে ‘ইসলামিক’ বানিয়ে রাখা যায় না। হালের ইসলামি ব্যাংক এবং কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় এর নজির। দেখুন, ‘ইসলামিক’

Read More »

পাপের প্রচার

একদিন মরে যাব। তবে এই মৃত্যু কেবল দৈহিক। রোজ হাশরে আমাদের সব ভালোমন্দের ফলাফল দেওয়া হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

Read More »