মুক্তি

পশ্চিমা সভ্যতা হলো মুক্ত পৃথিবী। এই পৃথিবীতে জীবনকে যাপনের জন্য কোনো নৈতিক সীমানা নাই, তাই সীমালঙ্ঘনেরও কোনো বালাই নাই। পশ্চিম প্রগতিশীল। এই প্রগতির কোনো ডিভাইন লক্ষ্য উদ্দেশ্য নাই। তাই পশ্চিমে মানুষ বেঁচে থাকে বস্তুবাদ ও ভোগবাদকে অবলম্বন করে৷ পশ্চিমে আপনি লাক্সারি ও গ্ল্যামারের সর্বোচ্চ চূড়া ছুঁতে পারবেন। মদ, মাদক, জুয়া ও নারীতে বুঁদ হতে পারবেন। পুঁজিবাদের কল্যাণে অগাধ অর্থবিত্তের মালিক হওয়া, কিম্বা জাগতিক আরাম-আয়েশ আর ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে এই পশ্চিমা পৃথিবীকেই আপনার জান্নাত বলে মনে হতে পারে।

আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,

مَن كَانَ يُرِيدُ ٱلْحَيَوٰةَ ٱلدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَٰلَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ

যারা শুধু পার্থিব জীবন এবং এর জাঁকজমকতা কামনা করে, আমি তাদের কৃতকর্মগুলির ফল দুনিয়াতেই দিয়ে দিই, তাদের জন্য কিছুই কম করা হয় না। (সুরা হুদ: ১৫)

অপর দিকে পুবে উদ্গত দর্শন ও মতবাদের বিষয়বস্তু ভোগবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। পুবের সাধারণ মানুষজন জাগতিক মুক্তির বদলে আত্মিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তি খোঁজে। এখানকার দর্শনগুলো জাগতিক ভোগ ও কামনা বাসনা থেকে মুক্ত হতে বলে। তাওবাদ-এর জনক লাউৎসে তার ‘তাও তে চিং’ গ্রন্থে তাওয়ের পথ অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাওয়ের পথ হলো প্রকৃতির পথ। আমরা প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃতি থেকে জন্ম, আবার প্রকৃতিতেই ফিরে যাব। বুদ্ধ বলেছেন, জগৎ দুঃখময়, আর এ দুঃখের কারণ হলো আমাদের জাগতিক কামনা-বাসনা। দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখের নিরোধও আছে। আর অষ্টমার্গের মাধ্যমে বুদ্ধ তার অনুসারীদের জাগতিক দুঃখের নিরোধ শিখিয়েছেন। জন্মান্তরের চক্র ভেদ করে সংঘের সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করেছেন মহানির্বাণ লাভে। মহানির্বাণ মানে চিরতরে নিভে যাওয়া, আর এটাই চূড়ান্ত মুক্তি।

হিন্দু থিওলজিসহ পুবের সমস্ত থিওলজি ও ফিলোসফি গভীরভাবে পড়লে আপনি যা পাবেন তা হলো সর্বেশ্বরবাদ, অর্থাৎ সবকিছুতে ঈশ্বর। সৃষ্টি মাত্রই স্রষ্টার ইচ্ছার প্রকাশ নয়; বরং সৃষ্টি স্রষ্টারই অংশ, যা প্রকৃতিগত কারণেই ফের স্রষ্টায় বিলীন হয়ে যায়; যেমন করে সমুদ্রে নুড়ি ফেলার পর উপরে ছলকে ওঠা জল আবার সমুদ্রেই বিলীন হয়ে যায়! পুব তাই পশ্চিমের সম্পূর্ণ বিপরীত। পুঁজিবাদ, বস্তুবাদ আর ভোগবাদের বদলে পুবের দর্শন তাই শেখায়—প্রকৃতিবাদ, আধ্যাত্মবাদ আর ভোগের বিপরীতে কঠোর সংযম।

ইসলামের প্রকৃতি এক্ষেত্রে কেমন? ইসলাম শেখায় মধ্যমপন্থা। ইসলামি ব্যবস্থায় ইহজাগতিকতা এবং আধ্যাত্মিকতার মধ্যে এক আশ্চর্য অভূতপূর্ব সমন্বয় রয়েছে।

আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,

قُلْ يٰعِبَادِ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱتَّقُوا۟ رَبَّكُمْۚ لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا۟ فِى هَٰذِهِ ٱلدُّنْيَا حَسَنَةٌۗ وَأَرْضُ ٱللَّهِ وَٰسِعَةٌۗ إِنَّمَا يُوَفَّى ٱلصَّٰبِرُونَ أَجْرَهُم بِغَيْرِ حِسَابٍ

বলো, (আমার এই কথা) হে আমার মু’মিন বান্দারা, তোমরা তোমাদের রাব্বকে ভয় করো। যারা এই দুনিয়ায় কল্যাণকর কাজ করে তাদের জন্য আছে কল্যাণ, প্রশস্ত আল্লাহর পৃথিবী। ধৈর্যশীলদেরকে অপরিমিত পুরস্কার দেওয়া হবে। (আয-যুমার: ১০)

ইসলাম সর্বক্ষেত্রেই মধ্যমপন্থাকে উৎসাহিত করে। ইসলাম ইহুদিদের মতো চরম অক্ষরবাদকে যেমন গ্রহণ করে না, তেমনি খ্রিস্টানদের মতো চরম ভাববাদকেও প্রশ্রয় করে না। ইসলামে অক্ষরবাদ আর ভাববাদের এক অপূর্ব ব্যালেন্স রয়েছে। যেভাবে ইসলাম ব্যালেন্স করে দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যে।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের দুয়া শিখিয়েছেন,

“হে আল্লাহ আমি আপনার নিকট ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করি দুনিয়া ও আখিরাতের। হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের দুনিয়ার কল্যাণ দান করুন, আখিরাতেরও কল্যাণ দান করুন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।” এই দুয়াটির একাংশ কুরআনে সূরা বাকারাতেও এসেছে।

তবে খুব গভীরভাবে খেয়াল করলে লক্ষ করবেন, ইসলাম যদিও মধ্যমপন্থার কথা বলে, মুসলিমরা যদিও মধ্যমপন্থি জাতি, তবু ইসলামের ঝোঁক বা প্রবণতা যুহুদ অর্থাৎ দুনিয়া বিমুখতার দিকে। আখিরাতের অর্জনকেই ইসলাম সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। অর্থাৎ মুসলিমরা দুনিয়াবি কাজেও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে আখিরাতে সুফল নিতে পারে। সুন্নাহ অনুযায়ী ঘুমালে মুমিনের ঘুমও ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়।  

আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,

অতএব যারা দুনিয়ার বিনিময়ে আখিরাত ক্রয় করে তারা যেন আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে; এবং যে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, অতঃপর নিহত অথবা বিজয়ী হয়, তাহলে আমি তাকে মহাপ্রতিদান প্রদান করব। (আন-নিসা: ৭৪)

হুযায়ফাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত—

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সোনা ও রূপার পাত্রে পান করতে নিষেধ করেছেন এবং বলেছেন, তা দুনিয়াতে তাদের (কাফিরদের) জন্য এবং তোমাদের জন্য আখিরাতে।

ইসলামে মুক্তি মানে পরকালীন মুক্তি। ইসলাম পশ্চিমের মতো দুনিয়াবি লাগামহীন মুক্ত পৃথিবীতে যেমন বিশ্বাস করে না, তেমনি পুবের মতো চরম দুনিয়াবিমুখতায়ও মুক্তি খোঁজে না। ইসলামে বৈরাগ্যবাদ নেই। ইসলাম ঈশ্বরহীনতা কিম্বা সবকিছুতেই ঈশ্বরের যে ধারণা—এর দুটোকেই রিজেক্ট করে। ইসলাম সীমানার মধ্যে ভোগ করার সুযোগ যেমন দেয়, তেমনি লাগামহীন ভোগের মানসিকতাকে নিরুৎসাহিত করে, ভোগ কম করতে উৎসাহিত করে।

দুনিয়াতেই সব পেয়ে যাওয়ার মানসিকতা মানুষকে আখিরাত বিমুখ করে ফেলে। দুনিয়া মুমিনের জন্য জেলখানা, একজন মুমিন সবসময়ই দুনিয়াতে একধরনের সীমানা অনুভব করে। তবু, সে সীমালঙ্ঘন করা থেকে বিরত থাকে। দুনিয়ার তথাকথিত মুক্তিকে যদিও জান্নাত মনে হয়; কিন্তু আসলে তা জাহান্নাম; দুনিয়ায় ইসলামি শরিয়তকে যদিও কঠোর, কঠিন আর দোজখবাস কিম্বা জেলখানা মনে হয়, আসলে তা জান্নাতের পথ। একমাত্র মুমিনরাই এই পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারে।

Share On:

Facebook
Twitter
LinkedIn

Related Posts:

‘ইসলামিক’ নাম দেওয়াই কি সার্থকতা?

নামকরণের মাধ্যমে কোনো প্রতিষ্ঠানকে ‘ইসলামিক’ বানিয়ে রাখা যায় না। হালের ইসলামি ব্যাংক এবং কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় এর নজির। দেখুন, ‘ইসলামিক’

Read More »

পাপের প্রচার

একদিন মরে যাব। তবে এই মৃত্যু কেবল দৈহিক। রোজ হাশরে আমাদের সব ভালোমন্দের ফলাফল দেওয়া হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

Read More »