মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক। স্যার একাধারে একজন দার্শনিক এবং সমাজকর্মী। তিনি সাম্প্রতিক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিন্তকদের একজন। কিন্তু স্যারের যে পটেনশিয়ালটি, তার তুলনায় তিনি খুবই আন্ডাররেইটেড। স্যারের কাজ যতটুকু ছড়ানোর কথা ছিলো, তিনি মোটেও ততটা এক্সপোজার পান না। আমি গত বেশ কয়েক বছর ধরেই স্যারের কাজের সমঝদার। স্যারের সাথে আমার বেশ কিছু লিঙ্গুয়াল মতপার্থক্য থাকার পরেও—আমি মনে করি, স্যার তার জায়গা থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ রোল প্লে করছেন।
আমি বিশ্বাস করি ওহির জ্ঞানের পাশাপাশি, একজন মানুষ তার সুস্থ জাগতিক যুক্তি-বুদ্ধি দিয়েও আল্লাহকে যথাসম্ভব বুঝতে পারে, এবং তাঁর প্রতি যুক্তিপূর্ণভাবেই ঈমানকে ধারণ করতে পারে। যুক্তি-বুদ্ধির জাগতিক সীমাবদ্ধতা থাকা স্বত্ত্বেও মানুষ তার র্যাশনালিটিকে অভিজ্ঞতা আর প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আরো উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে পারে।
মধ্যযুগের আশআরী মাতুরিদি কালামিদের প্রচুর থিওলজিকাল সমালোচনা থাকা স্বত্ত্বেও—তৎকালীন গ্রীক ফিলোসফির হেজেমনিকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে তারা যে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন—সেসবকে অস্বীকার করা মোটেও প্রাজ্ঞ ব্যক্তির কাজ না। আর এখন তো সেক্যুলার হেজেমনির যুগ! এই হেজেমনির মোকাবিলায় মুহাম্মাদ আসাদ, তালাল আসাদ, ওভামির আঞ্জুম, আবু নকিব আল আত্তাস, আব্দুলহামিদ আবুসুলাইমান, হাতিম বাজিয়ান কিংবা বাংলাদেশের মোজাম্মেল স্যাররা যে অবদান রাখছেন—তার সুফল আমরা হয়তো বেশ শীঘ্রই ভোগ করতে পারবো।

একটা সেক্যুলার সেটআপে থেকে ফান্ডমেন্টাল সেক্যুলারিজমের মোকাবিলা করা, এবং পাশাপাশি ইসলামের ওয়ার্ল্ডভিউ বজায় রেখে মুসলিম সমাজের উপযোগী সেক্যুলারিজমের একটি ফাংশনাল ন্যারেটিভ তৈরি করা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি, অন্তত যতদিন মুসলিমরা সভ্যতাগতভাবে পরাজিত অবস্থায় আছে! দুনিয়ার ইতিহাস ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার ‘এন্ড অব হিস্ট্রি’তে এসে থেমে যাবে না।
প্রি-কলোনিয়াল এরায় প্রায় সারা বিশ্বের সমাজই ছিলো থিওক্রেটিক। মুসলিমদের সমাজ, খ্রিস্টানদের সমাজ কিম্বা প্যাগানদের সমাজ—প্রত্যেক সমাজেই যারযার ধর্ম দীন অথবা সোশাল অর্ডার হিসেবে বিলং করতো। সমাজের রাজা-বাদশাগন ছিলো আল্লাহর অথবা বিভিন্ন কাল্পনিক দেব-দেবীর প্রতিনিধি। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ অথবা ধর্মহীনতার চিন্তা তখন ছিলো কল্পনাতীত ব্যাপার। সেই সময়েও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দুনিয়ায় এলেন, তিনিও বনি ইসরাইলদের অথরিটি মেনে অনেকদিন বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে সালাত আদায় করেছেন; যদিও ততদিনে বনি ইসরাইলরা অনুসরণের অযোগ্য হয়ে পড়েছিলো। আল্লাহর রাসূল যতদিন রাজনৈতিক শক্তি অর্জন না করেছেন, যতদিন পর্যন্ত দীন হিসেবে ইসলামের ভিত্তি মজবুতি অর্জন করে নি—ততদিন পর্যন্ত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর রাসূলকে আহলে কিতাবীদের সিম্বল হিসেবে বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে মুখ ফিরিয়ে সালাত আদায় করে যাওয়ার নির্দেশ দেন, যদিও পাশাপাশি আল্লাহ একইসাথে কুরআনের মাধ্যমে বনি ইসরাইলের সমালোচনা করে যেতে থাকেন।
আমরা মুসলিমরা এখন সভ্যতাগতভাবে পরাজিত জাতি। তাই বাধ্য হয়েই আমরা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বারা প্রভাবিত ও বিকশিত হচ্ছি। পোস্ট কলোনিয়াল এরায় জন্ম নেওয়া আমরা প্রত্যেকেই আধুনিকতার সন্তান। আমাদের মন-মনন ও মগজ সেই ধাঁচেই তৈরি হয়েছে—যা সেক্যুলার লিবারাল পশ্চিমের চোখে গ্রহণযোগ্য। আল্লাহর দীনকে তো আল্লাহই বিজয়ী করবেন। কিন্তু এই সেক্যুলার সেটআপেও একজন মুসলিমকে অবশ্যই তার সাধ্যমতো দীনের বিজয়ের জন্য কাজ করে যেতে হবে। অন্তত ইসলামের প্রাথমিক সময়ে ‘বনি ইসরাইলের দলিল দিয়েই বনি ইসরাইলকে ক্রিটিক করার মতো’ সেক্যুলার লজিক দিয়েই সেক্যুলারিজমের ক্রিটিক করে যেতে হবে—যতদিন আল্লাহ দীন এবং সভ্যতার কাঠামো হিসেবে ইসলামকে বিজয়ী না করেন।
ইসলাম শুধুমাত্র বিজয়ী অবস্থার জন্য না, পরাজিত অবস্থায়ও ইসলামের অনুসরণ করতে হবে; আর কীভাবে করতে হবে তার রেফারেন্সও ইসলামেই আছে। একটা পুরোদস্তুর প্যাগান সমাজে থেকেও ইউসুফ আলাইহিস সালাম কি আল্লাহর দীনের অনুসরণ করেন নি? তিনি কি প্যাগান সমাজে থাকার কারণে আল্লাহর ইবাদাতের ব্যাপারে কোনো প্রকার ওযর-আপত্তি করেছিলেন? তিনি কি একটা প্যাগান সোসাইটিতে থেকেও সমাজের নেতৃত্বের আসন গ্রহণ করেন নি? এখান থেকেই সভ্যতাগতভাবে পরাজিত মুসলিমদের জন্য গ্রহণ করার মতো যথেষ্ট শিক্ষা রয়েছে।
যাহোক, লেখা শুরু করেছিলাম মোজাম্মেল স্যারের কথা বলে। প্রাসঙ্গিক কথা বলতে বলতেই লেখা অনেক বড় হয়ে গেলো। মোজাম্মেল স্যার যথারীতি অনেক ভুল বোঝাবুঝির স্বীকার হন, ধর্মীয় অঙ্গন এবং সেক্যুলার অঙ্গন উভয় দিক থেকেই। কিন্তু তার চিন্তা আমাদের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ এবং বিবেচনার যোগ্য—তা বলার জন্যই আসলে এতএত কথা বলতে হয়েছে। আমি স্যারের কাছে গিয়েই প্রথম বুঝতে পেরেছি—সেক্যুলার লজিক এবং মানুষের সহজাত বোধবুদ্ধি দিয়েও আল্লাহর অস্তিত্ব বোঝা সম্ভব৷ আর এই বুঝটুকুই ফান্ডামেন্টাল সেক্যুলার জামানার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।