মডার্নিটির ভ্রান্তি এবং আমাদের বিশ্বাসের সংকট

ধরা যাক, মৃত্যুর পরে আর কোনো জীবন নেই। দুনিয়ার জীবনই আপনার একমাত্র জীবন। এ জীবনে আপনি তখন কী চাইবেন? জাগতিক সুখ, আরাম-আয়েশ, ইন্দ্রিয়লিপ্সা, অগাধ অর্থবিত্ত ইত্যাদি! কিম্বা চাইবেন, মানুষের আনাগত ইতিহাসে অমর হয়ে থাকতে। সে আশায় আপনি দিগ্বিজয়ী বীর হতে চাইবেন, হতে চাইবেন কোনো মহাকবি, আর্টিস্ট, ভাস্কর কিম্বা বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী বা আর্কিটেক্ট। মানবসভ্যতায় আপনি অবদান রাখতে চাইবেন, যাতে মানুষ আপনাকে আজীবন মনে রাখে। দেশের তরে আপনি জীবন দেবেন, যাতে দেশের মানুষ আপনার কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। প্রিয়ার বিরহে আপনি আত্মাহুতি দেবেন, যাতে মানুষ যুগযুগ ধরে আপনার প্রেমের কাহিনি থেকে প্রাণিত হতে পারে, আপ্লুত হতে পারে।

এই পুরো প্রক্রিয়াতে ধর্মের কী প্রয়োজন? একটু ভাবুন তো, যেকোনো ফরম্যাটে যদি পরকাল না থাকে– তবে মানবজাতির জন্য ধর্মের কী আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? প্রাচীন প্যাগান আরবরা বিভিন্ন দেব-দেবির পূজা করত তাদের জাগতিক স্বার্থে, যাতে ফলন ভালো হয়, আয় রোজগারে তরক্কি আসে, কিম্বা যেন প্রতিবেশী গোত্রের সাথে যুদ্ধে জয় আসে। হ্যাঁ, প্রত্যেক ধর্মেই কিছু নৈতিকতার সবক থাকে, সেসব নৈতিকতার চর্চার জন্য আদৌ কি কোনো ধর্মের অনুসরণের প্রয়োজন আছে? বিবর্তনবাদের ধারণা অনুসারে প্রাণীকুলের পাশাপাশি মানুষ যেমন বিবর্তিত হয়েছে, বিবর্তিত হয়েছে ধর্ম এমনকি নৈতিকতার ধারণাও। 

বর্তমান বিশ্বে যে নৈতিকতার ধারণা ডমিন্যান্ট, তা হলো পশ্চিমা সেক্যুলার লিবারাল নৈতিকতা। এই ডমিন্যান্ট নৈতিকতার রঙে রঙিন হচ্ছে বিভিন্ন ধর্মের নৈতিকতাও। একসময় যে ক্যাথলিক নৈতিকতায় সমকামীরা নরকে যেতো, তারা এখন শুধুমাত্র যীশুতে বিশ্বাস রেখেই সাচ্ছন্দ্যে স্বর্গলাভ করতে পারে। এখন বৈশ্বিক পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সুদ খাওয়া আর অনৈতিক নয়। ইসলামে পুরুষের বহুবিবাহের সুযোগ বরং ধীরে-ধীরে অনৈতিক হয়ে পড়ছে। অনৈতিক হয়ে পড়েছে জিহাদের ধারণা, মুসলিম নারীদের আপাদমস্তক পর্দা, গৃহবাস এবং অন্তর্মুখিতা।

নৈতিকতার ধারণা যেখানে বিবর্তিত হয়, সেখানে ধর্মের কী প্রয়োজন? মানুষ তো নিজেই নিজের জন্য নৈতিকতার ধারণা গড়ে নিতে পারে। অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাসিত ব্রিটিশ খুনি, চোর, সন্ত্রাসীরাও তো নিজেদের প্রয়োজনে একধরনের নৈতিক জীবনাচার বেছে নিয়েছিল। ধর্মের কী প্রয়োজন? আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মকে যদি আমরা যুগের প্রয়োজনে বদলে দিতে পারি, তবে খুব সম্ভবত যুগের প্রয়োজনে আমরা মানুষরাই আল্লাহর নাম দিয়ে ধর্মকে বানিয়েছি (নাউযুবিল্লাহ)! হতে পারে না?

ড্যানিয়েল হাকিকাতজু সম্ভবত ঠিক এই জায়গাতে এসে স্কেপটিক মুসলিম হয়েছেন, মর্ডানিটির বিরুদ্ধে মনস্তাত্বিক যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনি যুগের প্রয়োজনে ধর্মের বিবর্তিত হওয়াকে মেনে নিতে পারেন নি। কারণ, ধর্মীয় ভ্যালুজ যদি যুগের প্রয়োজনে আপসাইড ডাউন হয়ে পড়ে, তবে এমন ধর্মের অনুসরণ কোনো সেন্স মেইক করে না। যুগের প্রয়োজনে আমরা যদি কুরআনের ব্যাখ্যাকে সেক্যুলার লিবারালিজমের সাথে একাকার করে ফেলাতেই টিকে থাকার সমাধান খুঁজে পাই, তবে খুব সম্ভবত কুরআনটাই একটা অর্থহীন বই, অতীতের গালগল্প, মিথ, যার অর্থকে যুগের প্রয়োজনে বদলে যেতে হয় (নাউযুবিল্লাহ)।

কুরআনিস্ট যারা, তারা হাদীসকে রিজেক্ট করে। কারণ, বর্তমান দুনিয়ার চোখে যেটা প্রগতি, হাদীসের দৃষ্টিতে সেটা ফিতনা। আধুনিক মাইন্ডসেট এই ফিতনার ন্যারেটিভগুলোকে এক্সেপ্ট করতে চায় না। আধুনিক মাইন্ডসেন্ট রিলিজিয়াস মাইন্ডসেটকে রিজেক্ট করে, এটি বিশ্বাসের ঢেঁকি গিলতে চায় না। আধুনিক মাইন্ডসেট চায় আধুনিক সেক্যুলার লিবারালিজমের সাথে যায়, এমন একটি বিবর্তিত আধুনিক ধর্ম।

এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন তাড়না, যেটি এই আধুনিক মাইন্ডসেটকে প্রশ্ন করছে, রিলিজিয়াস মাইন্ডসেটে ফিরতে চাচ্ছে। এমনটা ঘটছে প্রায় প্রত্যেকটা ধর্মেই, এমনকি হিন্দু ধর্মেও।

শেষ জামানায় দজ্জালের ফিতনা থেকে বাঁচার জন্য বেশিবেশি সূরা কাহাফ পড়তে বলা হয়েছে। সূরা কাহাফে চারটা গল্প আছে। সে গল্পগুলোতে এমন লেসন আছে- যা একজন বিশ্বাসীকে ফিতনার কালে পথ চলার মতো প্রজ্ঞা দান করে। ফিতনার কালে চোখ দিয়ে নয়, প্রজ্ঞা দিয়ে পথ চলতে হয়। হাদীস কেন বিশ্বাস করি? কারণ, হাদীসের প্রফেসিগুলো নিজের চোখেই ফুলফিল হতে দেখি। আর হাদীসের বিশ্বাসনির্ভর রিলিজিয়াস মাইন্ডসেট যখন পশ্চিমের একচোখা দর্শন ও যুক্তি নির্ভর আধুনিক মাইন্ডসেটকে ফিতনার বাই প্রোডাক্ট ভাবা শুরু করে, তখন আধুনিক মাইন্ডসেটও হাদীসকে খারিজ করতে চায়।

এই হলো বর্তমানে ইসলাম আর মডার্নিজমের মধ্যকার ক্ল্যাশ। প্রায় প্রত্যেকটা ধর্মের সাথেই আধুনিকতাবাদ বা মডার্নিটির এ ধরনের ক্ল্যাশ বিদ্যমান। এই ক্ল্যাশে জড়িয়ে বিশ্বাসিদের মধ্যে কারো-কারো কিছু ব্যাপারে বাড়াবাড়ি আর কিছু ব্যাপারে ছাড়াছাড়ির প্রবণতা তৈরি হয়। এমন অবস্থায় সাধারণ বিশ্বাসীদের জন্য সিরাতুল মুস্তাক্বিম খুঁজে পাওয়াটা যেন বেশ দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় ইসলামের বিশুদ্ধ ইলম অর্জনের বিকল্প নেই। সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে, তিনি যেন আমৃত্যু সিরাতুল মুস্তাক্বিমের ওপরে রাখেন।

Share On:

Facebook
Twitter
LinkedIn

Related Posts:

man looking up at the sky

মুক্তি

পশ্চিমা সভ্যতা হলো মুক্ত পৃথিবী। এই পৃথিবীতে জীবনকে যাপনের জন্য কোনো নৈতিক সীমানা নাই, তাই সীমালঙ্ঘনেরও কোনো বালাই নাই। পশ্চিম

Read More »

‘ইসলামিক’ নাম দেওয়াই কি সার্থকতা?

নামকরণের মাধ্যমে কোনো প্রতিষ্ঠানকে ‘ইসলামিক’ বানিয়ে রাখা যায় না। হালের ইসলামি ব্যাংক এবং কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় এর নজির। দেখুন, ‘ইসলামিক’

Read More »

পাপের প্রচার

একদিন মরে যাব। তবে এই মৃত্যু কেবল দৈহিক। রোজ হাশরে আমাদের সব ভালোমন্দের ফলাফল দেওয়া হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

Read More »