মিনিমালিজম

ইংরেজি Minimalism শব্দের বাংলা অর্থ কী করা যায়? অল্পেতুষ্টিবাদ? হোক না। কিন্তু পারিভাষিক অর্থ না বলা হলে এমন শাব্দিক অর্থ অনেকেরই বোধগম্য হবে না। মিনিমালিজম বলতে বোঝায়- যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকু করা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ, অপচয় বা ভোগ না করা। জীবনের জন্য মিনিমাম যতটুকু সম্পদ প্রয়োজন- তা অর্জিত হলে তাতে তুষ্ট থাকা, কৃতজ্ঞ থাকা। আর এমন জীবন পদ্ধতি যারা মেনে চলেন তাদেরকে ডাকা হয়- ‘মিনিমালিস্ট’।

এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে মিনিমালিজমের ধারণাটা কেন গুরুত্বপূর্ণ? তার অনেক কারণ আছে। বিগত কয়েক শতাব্দীতে ইউরোপীয় পোস্ট কলোনিয়াল পুঁজিবাদপুষ্ট আগ্রাসী নব্য সংস্কৃতির দরুন মানুষ ক্রমেই ভোগবাদী হয়ে ওঠে। আরো আরো ভোগের চাহিদা পুঁজিপতিদের প্রেরণা যুগিয়েছে বেশিবেশি উৎপাদনে। যত ভোগের চাহিদা, তত উৎপাদন, আর ততই জীবপ্রকৃতি এবং পরিবেশের বিপর্যয়। গত কয়েক শতাব্দীতে মানুষের আগ্রাসী ভোগের চাহিদা মেটাতে গিয়ে উজাড় হয়েছে লক্ষ-লক্ষ হেক্টর বনাঞ্চল, দুষিত হয়েছে পানি, খনিজ জ্বালানি পুড়িয়ে দুষিত করা হয়েছে বায়ুস্তর। পৃথিবী আজ সত্যিকার অর্থেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে মেরুর বরফ গলে যাচ্ছে। সমুদ্রের পানির স্তর বৃদ্ধির সাথেসাথে আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তলিয়ে যাবে বিশাল পরিমাণ উপকূলীয় নিচু-ভূমি। কোটি কোটি মানুষ অচিরেই হবে ক্লাইমেট রিফিউজি।

মানুষের স্বাস্থ্যও ভালো নেই। অধিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে কীটনাশক আর রাসায়নিক সার। যা খাদ্যের উৎপাদন বাড়ালেও গুণগতমান কমিয়ে দিয়েছে বহুলাংশে। এছাড়া অধিক লাভের আশায় মুনাফাভোগীরা খাদ্যে মেশাচ্ছে বিষাক্ত ফরমালিন, কৃত্রিম রঙ, ভেজাল। এতে করে আমাদের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মারাত্বকভাবে। 

বেশিবেশি ভোগের তাড়নায় আমরা নষ্ট করে ফেলছি পৃথিবীর ইকোসিস্টেম। বনবাদাড় উজাড় এবং ভোগের উদ্দেশ্যে যত্রতত্র শিকারের ফলে ইতোমধ্যেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে অসংখ্য পশু-পাখির প্রজাতি, যারা ছিলো ধরিত্রীর ইকোসিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশিদার। ভোগের নেশায় মত্ত্ব আমরা ভুলেই যাই- প্রাণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা না গেলে আমরা নিজেরাও বাঁচতে পারবো না।

পৃথিবীর মোট পানির মাত্র ১% ভোজ্য মিঠা পানি। অথচ এই মিঠাপানির কী চরম অপচয়ই না আমরা করি। খুব বেশি দেরি নেই বিশ্বব্যাপি খাবার পানির চরম সংকট দেখা দেবে। আমাদের অত্যধিক ব্যবহার এবং অপচয়ের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির লেয়ার ইতোমধ্যেই অনেক নিচে নেমে গেছে। দক্ষিণ অফ্রিকার কেপটাউন, ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলিয় প্রদেশসমূহ, এমনকি আমাদের ঢাকাতেও দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। আমাদের অতিরিক্ত অপচয় যে যে সংকট বাড়াবে বই কমাবে না- তা বলাই বাহুল্য। 

আমাদের পৃথিবী ভালো নেই। পৃথিবীর বিশাল সংখ্যক মানবগোষ্ঠী ভালো নেই। নর্থ আমেরিকার লাস ভেগাসে যখন চলে ভোগবাদীতা আর অপচয়ের উন্মাদনা- খোদ আমেরিকারই ছোট্ট দেশ হাইতিতে মানুষ মরে অনাহারে অর্ধাহারে। আমাদের এই সুন্দর বসুন্ধরাকে বাঁচাতে, ধরিত্রীর সন্তানদের বাঁচাতে, প্রাণ ও প্রকৃতির ভারসাম্যকে বাঁচাতে- এই উন্মত্ত ভোগবাদীতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসাটা জরুরি। 

পুঁজিবাদী মনমানসিকতার অবসান হোক। ধরণী ফিরে পাক তার হারানো সৌন্দর্য। সবুজ জ্বালানি ও অর্থনীতির প্রচার, প্রসার ও চর্চাহোক বিশ্বব্যাপী। আমরা যেন ঠিক ততটুকুই ভোগ করি- যতটুকু আমাদের প্রয়োজন। মিনিমালিজমের ধারণা প্রসারিত হোক কোটি প্রাণে। অর্গানিক উৎপাদন ও চাষাবাদ বয়ে আনুক গন-সুস্বাস্থ্য। আমাদের বন আর নদীগুলো রক্ষা পাক। বায়ু ও পানি হোক দূষণমুক্ত। যদি আমরা জীবনপদ্ধতিতে সচেতনভাবে মিনিমালিজমের চর্চা করি- তবে বাঁচবে পৃথিবী। সাথে বাঁচবো আমরাও, ধরিত্রীর সন্তানেরা। 

Share On:

Facebook
Twitter
LinkedIn

Related Posts:

কোনোমতে পাশ!

আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকেই এমন যোগ্যতা দিয়েছেন যে—সে কোনোমতে দুনিয়া থেকে আল্লাহ প্রদত্ত রিজিক জোগাড় করে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। বেশিরভাগ

Read More »