কার্যকারণ সম্পর্ক ও সীমাবদ্ধ ইচ্ছার স্বাধীনতা

কার্য-কারণ সম্পর্ক বা Cause-Effect relation  বলতে বোঝায়- জগতে ঘটমান প্রত্যেকটা ঘটনার পেছনে নিশ্চিত রূপে এক বা একাধিক কারণ থাকে। অর্থাৎ জগতে যা-ই ঘটুক না কেন, তা কারণ বিনে ঘটে না। অর্থাৎ বলা যায়, আজকের পৃথিবী অসংখ্য chain reaction -এর ফলাফল, যার সূত্রপাত একটা আদি কারণ অথবা অনাদি cyclical কারণ থেকে। সে হিসেবে আমাদের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোও to some extend কার্য-কারণ সম্পর্কের বাইরে না। তার মানে কি আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা বলতে কিছু নেই?

প্রতিদিন আমরা অসংখ্য কাজ করি, অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিই। যাপিত জীবনে আমাদের মনে হয়- আমরা স্বাধীন ইচ্ছার মাধ্যমেই কর্ম সম্পাদন করি। অর্থাৎ, কর্মের ফলাফল আমাদের ইচ্ছাশক্তি আর প্রচেষ্টার উপরে নির্ভরশীল বলে আমরা মনে করি। কিন্তু আসলেই কি তাই?

আচ্ছা, একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুন, আপনি ভালো ড্রাইভ করতে পারেন, সমস্ত ট্রাফিক রুল মেনে চলেন। এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে সমস্ত ট্রাফিক রূল অনুসরণ পূর্বক আপনি ড্রাইভ করতে বের হলেন। কিন্তু এক মদ্যপ ট্রাক ড্রাইভার এসে আপনার গাড়িকে চাপা দিয়ে ছাতু বানিয়ে ফেললো। ফলাফল, দুর্ঘটনায় পড়ে আপনি মারা গেলেন! এখানে লক্ষ্য করুন, দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে থাকার সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আপনি দুর্ঘটনা এড়াতে পারেন নি। যদিও এখানে কার্য-কারণ সম্পর্ক ঠিকই বিদ্যমান ছিলো। ট্রাক ড্রাইভার মাতাল থাকার কারণে তাল সামলাতে না পেরে আপনার গাড়িকে চাপা দিয়েছে, কার্য-কারণ সম্পর্কের সমীকরণে এটাই কারণ। এখানে আপনার ইচ্ছার স্বাধীনতা কিম্বা প্রচেষ্টা- কোনোটাই আপনার নিয়তিকে প্রভাবিত করতে পারে নি।

আরেকটা উদাহরণ দিই। ধরুন, আপনি আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে বিষ খেলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে আপনার মরার কিম্বা না-মরার দু’টো পসিবিলিটিই থাকে। আপনি যার থেকে বিষ নিয়েছেন- সে আপনাকে ভেজাল বিষ দিয়ে থাকতে পারে। কিম্বা, কেউ আপনাকে বিষ খেতে দেখে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে আপনাকে বাঁচিয়ে দিতে পারে, অথবা খাওয়ার আগেই কেউ এসে আপনার হাত ধরে বিষ খাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে। এক্ষেত্রেও আপনার ইচ্ছা কিম্বা প্রচেষ্টা- দু’টোই ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা থেকে যায়।

অর্থাৎ, আপনার জীবনে যা কিছুই ঘটে- তা প্রতিনিয়তই কার্যকারণের আবর্তে ঘুরপাক খায়। আপনার জীবনের প্রভাবক শুধু আপনিই নন, আপনার পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র, সময়, পরিবেশ, ইত্যাদি অসংখ্য কার্য-কারণ ফ্যাক্টর এক্ষেত্রে জড়িত।

খেয়াল করলে দেখবেন, আপনার জীবনে স্বাধীন ইচ্ছার ভুমিকা খুবই সীমিত। আপনি শ্বাস না নিয়ে বাঁচতে পারেন না, না খেয়ে সুস্থ্য থাকতে পারেন না, প্রাকৃতিক কাজ না সেরে থাকাও আপনার পক্ষে সম্ভব হয় না। ‘আপনি প্রাকৃতিক কারণের বাই প্রোডাক্ট’ বললেও খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। তবে কি আপনার স্বাধীন ইচ্ছা আসলেন নেই?

আমার মতে—মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে। তবে সেটা সীমিত। ইচ্ছার স্বাধীনতাকে আমরা ‘প্রচেষ্টার স্বাধীনতা’ এবং ‘ফলাফলের স্বাধীনতা’ -এই দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। আমার প্রস্তাবনা হলো- আপনার প্রচেষ্টার স্বাধীনতা আছে, কিন্তু ফলাফলের স্বাধীনতা নেই। আপনি চয়েস করতে পারবেন, কিন্তু ফলাফল কার্যকারণ দ্বারা নির্ধারিত। আপনি সমস্ত ট্রাফিক রূল মেনে দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু দুর্ঘটনা থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে পারেন না। আপনি বিষ খাওয়ার ডিসিশন নিতে পারেন, বিষ খেতেও পারেন, কিন্তু মৃত্যু হবে কি হবে না, এটা আপনার হাতে নেই।

আমার প্রস্তাবনা হলো, আপনার ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে, কিন্তু সে স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ।

Share On:

Facebook
Twitter
LinkedIn

Related Posts:

কোনোমতে পাশ!

আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকেই এমন যোগ্যতা দিয়েছেন যে—সে কোনোমতে দুনিয়া থেকে আল্লাহ প্রদত্ত রিজিক জোগাড় করে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। বেশিরভাগ

Read More »

‘আলফা মেল’ প্রসঙ্গ

ইদানীং অনেকেই নিজেকে আলফা মেইল পরিচয় দেন। এটা নিতান্তই হাস্যরসিকতার ছলে হলেও ব্যাপারটা অনেকটা শ্রুতিকটু। শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে যারা আলফা পুরুষ—তাদের

Read More »