জামালের ভীষণ মন খারাপ। অন্যসময় বাসায় অল্প পরিমাণে হলেও কিছু ফিরনি পায়েশ রান্না হয় ঈদ উপলক্ষে। কিন্তু এবারের ঈদে কোনো আনন্দ নেই। ডাক্তার সাহেব প্রতিবছর চাঁদ রাতে বস্তিতে এসে জামালদের পরিবারের সবার জন্য ঈদের নতুন কাপড় দিয়ে যেতেন। প্যারালাইসিসের কারণে একহাত একপা অবশ হয়ে যাবার পর থেকে জামালের বাবা আর রিকশা চালাতে পারে না। জামালের মা বিভিন্ন ব্যাচেলর বাসায় বুয়ার কাজ করে কোনোমতে সংসার চালায়। বস্তির আর দশজন শিশুর মতো জামাল বেড়ে ওঠে ছন্নছাড়া হয়ে। বস্তির পাশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আপা এসে বস্তির বাচ্চাদের পড়িয়ে যায় মাঝেমাঝে। জামালের পড়তে ভালো লাগে না। জামাল স্বপ্ন দেখে- একদিন বড় হয়ে সে তার বাবার রিকশাটা চালাবে। তখন আর সংসারে কোনো অভাব থাকবে না।

একদিন জামাল বস্তির বাচ্চাদের সাথে মার্বেল খেলছিলো। হঠাৎ সিএনজি অটোরিকশা থেকে একজন মাইকে কী যেন সব বলে গেলো। এরপর হঠাৎ করেই যেন বস্তির পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে গেলো। অনেক বস্তিবাসীই বাক্সপেটরা গুছিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেলো। নতুন এক রোগ এসেছে নাকি, শরীরে ঢুকে ধীরেধীরে শরীরের কলকব্জা সব নষ্ট করে দেয়। এরপর অন্য একদিন জামালের মা কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরলো। ব্যাচেলর বাসার ছেলেগুলো নাকি বাড়ি চলে গেছে। মেস বাসা বন্ধ হওয়া মানে জামালের পরিবারের উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়া। জামাল বয়সে ছোট হলেও পরিবারের অভাব অনটনের কথা কিছুকিছু আঁচ করতে পারে। তাই সে মনে মনে ভাবে- তুহিনদের দোকানে টিভিতে দেখা সিনেমার নায়কের মতো একদিন বড় হয়ে সে-ও কোনো এক ধনীর ঘরের মেয়েকে বিয়ে করবে। বস্তিতে থাকা রহিম চাচার মতো সে-ও শশুর বাড়ি থেকে অনেক টাকা যৌতুক নেবে। তখন জামালের মায়ের আর কোনো কষ্ট থাকবে না। মায়ের বদলে জামাল তখন বউকে দিয়ে ঘরের সব কাজ করাবে। জামালের মা তখন পায়ের উপর পা তুলে খাবে।
প্যারালাইসিস হওয়ার আগে জামালের বাবা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ঘরে ফিরতো। জামালের মা কিছু বলতে পারতো না। কিছু বলতে গেলেই বেদম মার খেতে হতো। মায়ের ডুকরে কান্নার শব্দে জামালের ঘুম ভেঙে যেতো। জামালকে তার বাবা জোর করে বাইরে ভিক্ষা করতে পাঠাতো। বলতো- বেশি টাকা না এনে দিতে পারলে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। জামাল তাই রহিম চাচার ছেলে রানার সাথে মিলে মলে-বাজারে ঘুরতো, আর টাকার জন্য খদ্দেরদের হাতে-পায়ে ধরতো। যতক্ষণ টাকা না পেতো- জামাল আর রানা সেসব খদ্দেরদের হাত ছাড়তো না। খদ্দেররা বিরক্ত হয়ে দু’চার-পাঁচ টাকা তুলে দিতো তাদের হাতে।
অথচ এখন বাইরে বেরুনো বন্ধ। পুরো বস্তিই প্রায় খালি। জামালরা আছে অল্প কয়েক পরিবার। প্যারালাইসিস স্বামীকে নিয়ে এত ধকল সয়ে জামালের মা গ্রামের বাড়িতে যেতে রাজি হয় নি। প্যারালাইসিস হবার পর থেকেই জামালের বাবা একপ্রকার গৃহবন্দী জীবন কাটাতো। আগের সস্তা মদ খাবার সেই জৌলুশ আর নেই। এখন জামালের বাবা ঘরের কোণে বসে আগের কেনা পুরাতন বিড়ি ফোঁকে আর খুকখুক করে কাশে। কাশির শব্দে জামালের মা কেন জানি বারবার আঁতকে ওঠে। এই বুঝি তার স্বামীকেও এই দুরারোগ্য বালাইয়ে পেয়ে বসলো! জামাল এসব খেয়াল করে।
দেখতে দেখতেই রোজার মাস চলে এলো। রোজার মাস আসলেই বস্তির বাচ্চা-কাচ্চারা অনেক খুশি থাকে। বিভিন্ন মসজিদে খেঁজুর – জিলাপি ইত্যাদি পাওয়া যায়। তারাবির নামাজে গিয়ে পেছনের কাতারে দাঁড়িয়ে বাচ্চা-কাচ্চাদের চলে অবাধ্য খুনসুটি। এ ওর চুল টানে তো- ও এর টুপি কেড়ে নেয়। এবার আর সেসবের কিছুই হচ্ছে না। অল্প ক’জন মুরুব্বী বাদে কেউই এবার তারাবির নামাজ পড়তে মসজিদে যেতে পারছে না।
এ দিকে জামালের মায়ের অল্প আয়ে কেনা চাল-ডাল, তেল-নুন দেখতে দেখতেই ফুরিয়ে এলো। জামালের মা প্রায়ই চুলার দুয়ারে দাঁড়িয়ে আনমনে কাঁদে। কিছুই জামালের নজর এড়ায় না। এবার জামাল ভাবে- বড় হয়ে রিকশা না চালিয়ে সে বরং চালের আড়তে কাজ নেবে। তাহলে জামালদের আর ভাতের অভাব হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী আপা একদিন কিছু ছেলেপেলে নিয়ে এসে বস্তির যে কটা পরিবার রয়ে গেছে- তাদের মাঝে কিছু প্যাকেট বিতরণ করলো। প্যাকেটগুলো দেখে জামালের মা খুব খুশি হয়। প্যাকেটে ছিলো চাল-ডাল, তেল-নুন, ছোলা-খেঁজুর আর কিছু সবজি। ক্ষিদে জামালের সহ্য হয় না। মাঝখানে জামালরা ক’দিন একপ্রকার না খেয়েই ছিলো। তাই প্যাকেট ভর্তি খাদ্য-দ্রব্য পেয়ে জামালও খুব খুশি হলো।
অবশেষে ঈদ চলে এলো। চাঁদ রাতে জামাল আর তার মা অপেক্ষা করছিলো- ডাক্তার সাহেব আসবেন ঈদের নতুন জামা নিয়ে। সেই সাথে এবার হয়তো কিছু সেমাই-চিনিও মিলতে পারে। কিন্তু চাঁদ রাতে ডাক্তার সাহেব এলেন না। পরদিন সকালে মাইকে করে শোক সংবাদ ভেসে এলো। করোনার রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে ডাক্তার সাহেব নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন। আজ ঈদের দিন খুব ভোরে তিনি মারা গেছেন।