সেক্যুলারিজম শব্দের বাংলা বিশুদ্ধ পরিভাষা আছে কিনা বা হতে পারে কিনা- তা বেশ তর্ক সাপেক্ষ ব্যাপার। বাংলায় সাধারণত সেক্যুলারিজমের অর্থ করা হয়ে থাকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’। আমার মতে, এই পরিভাষায় যথেষ্ট গলদ আছে। এর থেকেও বেশি গলদ আছে সেক্যুলারিজম সম্পর্কে আমাদের আন্ডার্স্ট্যান্ডিং -এর জায়গাতে।
ইসলামপন্থীদের মধ্যে যারা সেক্যুলারিজমের সর্বব্যাপী আগ্রাসন ও এর দ্বীনি ব্যাপারটা দেখতে পান না কিম্বা বুঝতে পারেন না- তারাই সেক্যুলারিজমের ইসলামসম্মত ব্যাখ্যা বানাতে যান। এই ধরণের ব্যাখ্যাকে বলা যায় সুবিধাবাদীতার জায়গা থেকে গোলেমালে ব্যাখ্যা। সেক্যুলারিজম শুধু রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করার কোনো প্রজেক্ট নয়- বরং এর সর্বব্যাপী আগ্রাসন থেকে মুক্ত থাকে না- রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি- এমনকি ধর্মও।

সেক্যুলারিজমের প্রভাবে হিন্দু মুনি ঋষিদের যোগ সাধনা হয়ে উঠেছে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ যোগ ব্যায়াম। ব্যক্তির যুক্তিবোধ থেকে বাদ গেছে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া। একাডেমিয়া হয়ে উঠেছে নিরেট বস্তুবাদী।
সেক্যুলারিজমকে বলা যায় ইহজাগতিকতা, বস্তুবাদ, ভোগবাদ আর অভিজ্ঞতাবাদের সমন্বয়। সেক্যুলারিজম এবং মর্ডান লিবারালিজমেরও কাস্টমাইজড মোরাল অবলিগেশন আছে। যেমন আপনাকে হোমোফোবিক হওয়া যাবে না। আপনাকে সর্বপ্রকারের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হতে হবে। আপনাকে রেসিস্ট হওয়া যাবে না। ব্যক্তিগত ধর্মপালনের অধিকার থাকবে।
সুতরাং মুসলিমদের জন্য সেক্যুলারিজমের কিছু জিনিস উপযোগী আবার কিছু জিনিস অনুপযোগী। যেমন আপনি রেসিস্ট হবেন না, এটা ইসলাম সম্মত (একটা পর্যায় পর্যন্ত), কিন্তু হোমোফোবিক হবেন না- এটা মানতে পারা একজন মুসলিমের পক্ষে সম্ভব নয়। একজন মুসলিম কখনোই সমকামিতাকে সাপোর্ট করতে পারে না।
সেক্যুলারিজমের রিচ্যুয়ালিস্টিক এবং ট্রান্সেন্ডেন্টাল ব্যাপার স্যাপারও আছে। আছে সেক্যুলারদের নির্দিষ্ট অভ্যর্থনার ধরন। যেমন- সুপ্রভাত, শুভরাত্রি, অথবা কেউ মারা গেলে বাংলাদেশের সেক্যুলাররা ‘ইন্নালিল্লাহ’ না পড়ে বলে- ‘ওপারে ভালো থাকুক’, যদিও ওপার বলতে তারা কী বোঝায় তা ঠিক ক্লিয়ার না।
সেক্যুলারিজমের নানা ধারা উপধারা আছে। সবচাইতে চরমপন্থী সেক্যুলারিজম হলো ফেঞ্চ ধারার সেক্যুলারিজম। ব্রিটিশ কিম্বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সেক্যুলারিজম তুলনামূলক উদার। আর তুরষ্কের এরদোয়ান অনুসৃত সেক্যুলারিজম মুসলিমদের জন্য উপযোগী ধারাগুলোর একটি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, পিউরিটান সেক্যুলাররা এরদোয়ানের ধারাকে সেক্যুলারিজম হিসেবে মেনে নিতে নারাজ, বরং তারা একে বলে পলিটিক্যাল ইসলাম।
পলিটিক্স বা রাজনীতি ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা বা দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। সুতরাং কেউ চাইলে ইসলামের এই রাজনৈতিক আসপেক্টকে ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’ বলতেই পারে।
কিন্তু ইসলামপন্থী বুদ্ধিজীবী মহলের কেউকেউ আজকাল নিজেদের রাজনৈতিক চিন্তাকে ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’ না বলে বরং সেক্যুলারিজম বলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাদের চিন্তার সেক্যুলারিজম কোনোভাবেই সেক্যুলারিজমের পশ্চিমা ভার্সন নয়, বরং একধরণের ইসলামিকেট ভার্সন। সেক্যুলারিজম যেহেতু আমূলে পশ্চিমা একটা দর্শন- সেহেতু আমাদের ট্রেডিশনাল আলেম ওলামারা এই ধরণের ইসলামিকেট সেক্যুলারিজমেরও বিরোধিতা করেন।
আধুনিক ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তকদের অনেকে বলেন- যেহেতু ইসলাম শুধুমাত্র ধর্ম নয়, বরং পুর্নাঙ্গ দ্বীন- সুতরাং রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে, যেহেতু রাষ্ট্র কোনো ধর্মের মানুষদের প্রতিই পক্ষপাতী হবে না, যেহেতু রাষ্ট্রের ধর্মপালন করা (অর্থাৎ নামায, রোজার মতো রিচ্যুয়াল) লাগে না। সে সকল চিন্তকদের কাছে আমার প্রশ্ন- রাষ্ট্র কি দ্বীন নিরপেক্ষ হতে পারে? ইসলাম যেহেতু দ্বীন- সেহেতু রাষ্ট্র কি ইসলাম নিরপেক্ষ হতে পারে?
আমাদের ট্রেডিশনাল আলেম ওলামারা যখন ধর্ম নিরপেক্ষতার বিরোধিতা করেন- তারা মূলত এখানে ধর্ম হিসেবে দ্বীনকেই বুঝে থাকেন। রাষ্ট্র নামায পড়ে না, রোজা রাখে না- এই অর্থে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে, কিন্তু শরীয়াহ আর ইনসাফের প্রশ্নে রাষ্ট্র কখনোই দ্বীন নিরপেক্ষ হতে পারে না। মুসলিমদের রাষ্ট্র কখনোই সমকামী বিবাহ আইন পাশ করতে পারে না। মুসলিমদের রাষ্ট্র কখনোই ‘লিভ টুগেদার’ কিম্বা মদ্যপানের বৈধতা দিতে পারে না। মুসলিমদের রাষ্ট্র কখনোই ব্লাসফেমিকে টলারেট করতে পারে না।

Political Islam যেমন ইসলামিক ওয়ার্ল্ডভিয়্যু বা ইসলামী দ্বীনের একটা বেশ ছোট অংশ, তেমনি Political Secularism -ও সেক্যুলার ওয়ার্ল্ডভিয়্যু বা সেক্যুলার-দ্বীনের একটা ছোট অংশ। আমার মতে, ইসলামের বিরুদ্ধে না গেলে রাজনৈতিক ট্যুল বা সিস্টেম হিসেবে Political Secularism কে মুসলিম সমাজে এডপ্ট করা যেতে পারে। ন্যায়বিচার, সুশাসন, সকলের ধর্ম পালনের অধিকার কিম্বা রাষ্ট্র কোনো সংখ্যালঘু ধর্মবিশ্বাসীর প্রতি জুলুম করবে না- এই অর্থে ইসলামি সভ্যতার মূল্যবোধ সবসময়ই সেক্যুলার এবং ইসলামিক দু’টোই ছিলো।
কিন্তু সেক্যুলারিজম যখন আমাদের কাছে দ্বীন হিসেবে হাজির হয়- সেটা কখনোই মুসলিম সমাজ মেনে নিতে পারে না।
আমার মতে সেক্যুলারিজম শব্দটা এভোয়েড করা গেলেই ভালো। প্রি কলোনিয়াল যুগে মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজম নামে কিছু ছিলো না; যদিও সততা, ইনসাফ আর ইহসান অর্থে Political Secularism -এর বোধ বা এসেন্স মুসলিম সমাজে তখনও ছিলো। তখনকার সময়ে যেহেতু ইনসাফ আর ইহসানের ন্যারেটিভে সিস্টেম্যাটিক পলিটিক্সকে ‘সেক্যুলারিজম’ বলা লাগে নি- এখন কেন লাগবে?
আমার মতে, সেক্যুলারিজমের ইসলামাইজেশনের বদলে ইসলামি চিন্তাবিদদের উচিত মুসলিম সমাজের উপযোগী করে ইনসাফ ও ইহসানের ন্যারেটিভ হাজির রেখে নিজেদের মতো করে অর্গানিক ইসলামি পরিভাষা ও রাজনৈতিক পদ্ধতি তৈরি করা। সেটাই বরং সাধারণত মুসলিম উম্মাহ এবং আলেম সমাজের কাছে আরো অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে বলে আমার ধারণা।