‘ইসলামিক’ নাম দেওয়াই কি সার্থকতা?

নামকরণের মাধ্যমে কোনো প্রতিষ্ঠানকে ‘ইসলামিক’ বানিয়ে রাখা যায় না। হালের ইসলামি ব্যাংক এবং কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় এর নজির। দেখুন, ‘ইসলামিক’ শব্দটা ইউজ করে হয়তো আপনি কিছুদিনের জন্য একটা প্রতিষ্ঠানের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারবেন, কিন্তু সেটা কখনোই দীর্ঘস্থায়ী এবং সার্বজনীন হয়ে উঠতে পারবে না।

সেক্যুলাররা কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম ‘অমুক সেক্যুলার ইউনিভার্সিটি’ রাখেন নি। কোনো ব্যাংকের নামকরণ আজ পর্যন্ত ‘তমুক পুঁজিবাদী ব্যাংক’ রাখা হয় নি। এসব প্রতিষ্ঠানের আইডিয়োলজিক্যাল প্রি-এজাম্পশনই হলো বিশ্ববিদ্যালয় মাত্রই সেক্যুলার, ব্যাংক মাত্রই পুঁজিবাদী। অথচ লক্ষ্য করুন, প্রাথমিক ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর স্থপতি কিন্তু কোনো সেক্যুলার ছিলো না, এগুলো খ্রিস্টান ধর্মজাযকরা প্রতিষ্ঠা করেছিলো। কোনো সেক্যুলার লিবারাল কিন্তু নিজেদের পার্সিয়াল আইডেন্টিটি তৈরির স্বার্থে ‘অক্সফোর্ড লিবারাল ইউনিভার্সিটি’ নামে কোনো আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরির চিন্তা করে নি; বরং তারা এসব প্রতিষ্ঠানের ইনেট আইডিয়াকেই চেইঞ্জ করে দিয়েছে ধীরেধীরে।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে তাকালেও দেখবেন—কোনো বিখ্যাত মাদ্রাসার নাম ইসলামিক মাদ্রাসা নামকরণের প্রয়োজন হয় নি। মাদ্রাসার ধারণাটাই ফান্ডামেন্টালি ইসলামিক ছিলো। তাই আলাদা করে এটাকে ‘ইসলামিক’ বলার কোনো প্রয়োজনীয়তাই তখন দেখা দেয় নি। একটা সভ্যতা যখন বিজয়ী থাকে, তখন সেটা খুব স্বাভাবিকভাবেই তার সার্বজনীন রূপ প্রকাশ করে। যখন সেটা পরাজিত থাকে—তখন তার মধ্য নানারূপ হীনমন্য আচরণ প্রকাশ পায়। প্রতিষ্ঠানের ‘ইসলামি’ নামকরণ, কিংবা পাশ্চাত্য সভ্যতার ধারণাগুলোর ইসলামাইজেশন প্রজেক্টও কিন্তু মুসলিম সভ্যতার পরাজিত মানসিকতা এবং হীনমন্যতার বহিঃপ্রকাশ।

মুসলিমদের যতদিন সিভিলাইজেশ্যনাল ডমিনেন্স অর্জিত না হবে—ততদিন তারা এমন হীনমন্যই থেকে যাবে। রাজশক্তি নেই যার, সে-ই হীনবল। রাজশক্তির হাত ধরে আসে ক্ষমতা, ক্ষমতার হাত ধরে আসে বানিজ্য, বানিজ্যের হাত ধরে আসে অর্থ, আর অর্থে হাত ধরে আসে সভ্যতা। এ জাতির না আছে নিজস্ব রাজশক্তি, না আছে সভ্যতার স্বাতন্ত্র্যবোধ। যে সভ্যতা বিজয়ী হয় না, তা কখনোই সার্বজনীন রূপে গৃহীত হয় না; তা যতই লিবারালাইজেশন আর ইসলামাইজেশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাক না কেন! এগুলো বরং সভ্যতার নিজস্বতাকেই ব্লার করে দিতে থাকে।

এক্ষেত্রে একটা ইকুয়েশন বলি,

ইসলামাইজেশন = সেক্যুলারাইজেশন

আল্লাহর কিতাব পড়লে, রাসূলুল্লাহর সীরাহ এবং হাদীস পাঠ করলে, আসহাবে রাসূলদের চোখে দুনিয়াকে দেখলে যে ওয়ার্ল্ডভিউ আপনার মানসপটে তৈরি হয়—ওয়াল্লাহি বর্তমান আধুনিক পৃথিবী আর ইসলামের আধুনিকায়ন প্রচেষ্টা সে ওয়ার্ল্ডভিউকে ধারণ করে না, বরং সেই ওয়ার্ল্ডভিউ বিরুদ্ধে নিজের অজান্তেই একধরণের ক্রুশেডে লিপ্ত হয়।

যখনই মুসলিমদের ঈমান আকিদায় বিভ্রান্তি আর বিচ্যুতি তৈরি হবে—রাসূল (সা) এক্ষেত্রে উম্মাহকে বারবার কুরআন সুন্নাহর দিকে ফিরতে বলেছেন। এখন আমরা তো কুরআন-হাদীস পড়ার সময়ই পাই না। তাই নিজেদের হাওয়া তথা মন-মর্জিকে একপ্রকার খোদা বানিয়ে নিয়েছি। অর্থাৎ নিজের দৃষ্টিতে যা ভালো মনে হয় সেটাই ভালো, আর যা খারাপ মনে হয় সেটাই খারাপ।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর কালামে বলেছেন—

أَفَرَءَيْتَ مَنِ ٱتَّخَذَ إِلَٰهَهُۥ هَوَىٰهُ وَأَضَلَّهُ ٱللَّهُ عَلَىٰ عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَىٰ سَمْعِهِۦ وَقَلْبِهِۦ وَجَعَلَ عَلَىٰ بَصَرِهِۦ غِشَٰوَةً فَمَن يَهْدِيهِ مِنۢ بَعْدِ ٱللَّهِۚ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ

তুমি কি লক্ষ্য করছ তাকে, যে তার খেয়াল খুশীকে নিজের মা‘বূদ বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ জেনে শুনেই তাকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং তার কর্ণ ও হৃদয় মোহর করে দিয়েছেন এবং তার চক্ষুর উপর রেখেছেন আবরণ। অতএব, কে তাকে পথ নির্দেশ করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবেনা? [কুরআন—৪৫:২৩]

কিয়ামাতের পূর্বে দাজ্জালের আগমনের পূর্বে বেশিবেশি সূরা কাহাফ পাঠের হিকমত হলো এই—সূরা কাহাফ আমাদের শেখায়—যা আল্লাহ আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন—তা আপাত দৃষ্টিতে অকল্যাণকর মনে হলেও আদতে তা কল্যানকর, আর তিনি যা নিষিদ্ধ করেছেন—তা আপাত দৃষ্টিতে কল্যাণকর মনে হলেও আদতে তা অকল্যাণকর। শেষ জামানায় এই বিভ্রান্তি বহুগুণে বাড়বে বিধায় আল্লাহর রাসূল আমাদের বেশিবেশি সূরা কাহাফ পাঠের নির্দেশ দিয়েছেন।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন—

كُتِبَ عَلَيْكُمُ ٱلْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَّكُمْۖ وَعَسَىٰٓ أَن تَكْرَهُوا۟ شَيْـًٔا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْۖ وَعَسَىٰٓ أَن تُحِبُّوا۟ شَيْـًٔا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْۗ وَٱللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

জি-হা-দকে তোমাদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য রূপে অবধারিত করা হয়েছে এবং এটি তোমাদের নিকট অপ্রীতিকর; বস্ত্তত: তোমরা এমন বিষয়কে অপছন্দ করছ যা তোমাদের পক্ষে বাস্তবিকই মঙ্গলজনক, পক্ষান্তরে তোমরা এমন বিষয়কে পছন্দ করছ যা তোমাদের জন্য বাস্তবিকই অনিষ্টকর এবং আল্লাহই (তোমাদের ভাল-মন্দ) অবগত আছেন এবং তোমরা অবগত নও। [কুরআন — ২:২১৬]

আমি আল্লাহর কাছে দুআ করি, আল্লাহ যেন আমাকে সঠিকভাবে তার ইবাদত করার তাওফিক দেন। আল্লাহ যেন আমাকে আমার বিগত গুনাহসমূহকে মাফ করে দেন। যে গুনাহ করেও অহংকারবসত আল্লাহর কাছে তাওবা করে নি, এমন নালায়েক ও দূর্ভাগা হওয়া থেকে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই।

হে আল্লাহ, তুমি আমাদের ফুরকান দিয়েছো। অথচ আমরা এতটাই দুর্ভাগা যে তা খুলে দেখা এবং তা দিয়ে সত্য মিথ্যাকে আলাদা করার মতো সামর্থ্য আমাদের লুপ্ত হয়েছে। তুমি যদি আমাদের ক্ষমা না করো, তুমি যদি আমাদের সরল পথে চলার মতো সাহস ও সামর্থ্য না দাও—তবে আমরা চিরস্থায়ী ধ্বংসে পতিত হবো। ইয়া আল্লাহ আমাদের কা/ফির সম্প্রদায়ের মোকাবিলায় বিজয়ী করো।

Share On:

Facebook
Twitter
LinkedIn

Related Posts:

man looking up at the sky

মুক্তি

পশ্চিমা সভ্যতা হলো মুক্ত পৃথিবী। এই পৃথিবীতে জীবনকে যাপনের জন্য কোনো নৈতিক সীমানা নাই, তাই সীমালঙ্ঘনেরও কোনো বালাই নাই। পশ্চিম

Read More »

পাপের প্রচার

একদিন মরে যাব। তবে এই মৃত্যু কেবল দৈহিক। রোজ হাশরে আমাদের সব ভালোমন্দের ফলাফল দেওয়া হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

Read More »