সূচনা: জ্ঞানের ঐশী ভিত্তি
ইসলামি শিক্ষার ইতিহাস মানবসভ্যতার উন্মেষের মতোই প্রাচীন ও তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা বিশ্বাস করি—প্রথম মানব আদম আলাইহিস সালাম-এর সৃষ্টির সময় থেকেই এই সভ্যতার যাত্রা শুরু। আর শিক্ষার সূচনা হয় সেই ঐশী মুহূর্ত থেকে, যখন মহান আল্লাহ তাআলা আদম আ.-কে সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দেন। এই জ্ঞানই ছিল মানবজাতির ও মানবসভ্যতার প্রথম পাঠ। পরবর্তীতে যুগে যুগে নবি-রাসুলগণের আগমনের মধ্য দিয়ে এই জ্ঞান ও শিক্ষার ধারা অব্যাহত থাকে, যা মানবসমাজকে সিরাতুল মুসতাকিমের পথ দেখিয়েছে।
ইসলামের সর্বশেষ রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়কালকে আমরা যদি ইসলামি সভ্যতার আনুষ্ঠানিক সূচনাবিন্দু ধরি, তবে শিক্ষার নবযাত্রা শুরু হয় সেই দিন—যেদিন আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতা জিবরিল আ. প্রথম ওহী নিয়ে আসেন—‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’।
এই প্রথম ঐশী বাণীই ছিল জ্ঞানার্জন ও পাঠের প্রতি এক দ্ব্যর্থহীন আহ্বান। ইসলামে জ্ঞানার্জনকে সবসময়ই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যার প্রমাণ পবিত্র কুরআন ও রাসুল সা.-এর অসংখ্য হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান।

প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র: দারুল আরকাম থেকে মসজিদে নববী
মদিনায় হিজরতের পূর্বে মক্কায় প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও জ্ঞানচর্চা থেমে থাকেনি। রাসুল সা. নিজের বাসগৃহের পাশাপাশি ‘দারুল আরকাম’-কে একটি গোপন শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতেন। সেখানে তিনি সাহাবিদের একত্রিত করে ইসলামের আকিদা ও শরিয়ত শিক্ষা দিতেন। হিজরতের পর মদিনায় নবনির্মিত ‘মসজিদে নববি’ দ্রুতই ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। এখানে রাসুল সা. নিয়মিত খুতবা ও দারস (বক্তৃতা ও পাঠ) প্রদান করতেন। সাহাবিগণও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে জ্ঞানচর্চা ও আলোচনায় মশগুল থাকতেন, যা মসজিদকে একটি জীবন্ত বিদ্যাপীঠে রূপান্তরিত করে।
প্রাথমিক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ: মক্তবের সূচনা
বদর যুদ্ধের পর একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে। যুদ্ধবন্দী শিক্ষিত কাফিরদেরকে মুক্তিপণ হিসেবে মদিনার শিশুদের আরবি পড়া ও লেখা শেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এটিকে মুসলিম সমাজে আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা বা ‘মক্তব’-এর প্রাচীনতম রূপ বলা যেতে পারে। এটি প্রমাণ করে, ইসলাম শুরু থেকেই শিক্ষার প্রসারে কতটা বাস্তবমুখী ও উদ্ভাবনী ছিল। (মুবাররিদ, আল-কামিল, পৃ. ১৭১)
কুরআন: ভাষা, সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার চালিকাশক্তি
আরবি ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ, ব্যাকরণ প্রণয়ন এবং গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের প্রভাব ও প্রেরণা ছিল অতুলনীয়। বলা যায়, কুরআনই একটি তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা জাতিকে নিজস্ব জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার সুবিন্যস্ত কাঠামো গড়ে তোলার ভিত্তি স্থাপন করে দেয়। কুরআনের ভাষাগত সৌকর্য ও নির্ভুলতাকে মানদণ্ড ধরে আরবি ভাষার ব্যাকরণিক কাঠামো ও বিন্যাস চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। অসংখ্য মুসলিম মনীষী এই মহান কাজে সরাসরি অবদান রাখেন।
জ্ঞানার্জনের সফর ও মাজহাবের উন্মেষ
ইসলামের প্রাথমিক যুগে খলিফাগণ আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের লক্ষ্যে বিজয় অভিযান পরিচালনা করেন। ফলে বহু সাহাবি আরব উপদ্বীপের বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। এতে রাসুল সা.-এর হাদিসসমূহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। এই হাদিসগুলো সংগ্রহ, যাচাই-বাছাই ও সংকলনের জন্য মুহাদ্দিসগণ দূর-দূরান্তে দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য সফর শুরু করেন।
ইসলামের প্রথম তিন প্রজন্মে কুরআন, তাফসির, হাদিস এবং ফিকহ চর্চাই ছিল শিক্ষার মূল বিষয়বস্তু। প্রাথমিক যুগে কুরআন পাঠ ও মুখস্থকরণ ছিল শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যে মসজিদগুলো হয়ে ওঠে অসংখ্য অবৈতনিক শিক্ষাকেন্দ্রের প্রাণকেন্দ্র। শিক্ষকগণ কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই নিঃস্বার্থভাবে জ্ঞান বিতরণ করতেন। এই অবৈতনিক শিক্ষাকাঠামো মূলত দুটি ধারায় পরিচালিত হতো—
ক. মসজিদে নিয়মিত দারস বা পাঠচক্র।
খ. শিক্ষকের নিজ বাসগৃহে বা খানকাহে শিক্ষাদান।
হাদিস সংকলনের বিশাল কর্মযজ্ঞ চলার পাশাপাশি পৃথিবীবিখ্যাত ফকিহগণ ও তাদের ছাত্ররা কুরআন ও হাদিসের গভীর অধ্যয়নের মাধ্যমে জীবনের প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল বের করতে শুরু করেন। এভাবেই ধীরে ধীরে সুসংহত ফিকহি চিন্তাধারা বা ‘মাজহাব’-এর বিভিন্ন স্কুল বা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

বৈতনিক শিক্ষা: মক্তব ও মুয়াদ্দিব
ইসলামের ইতিহাসে বৈতনিক শিক্ষাকাঠামোর প্রাথমিক রূপ হিসেবে ‘মক্তব’ বা ক্ষুদে পাঠশালার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বৈতনিক হলেও এসব পাঠশালার খরচ ছিল নিতান্তই সামান্য। এখানকার শিক্ষকরা ‘মুয়াল্লিম’ নামে পরিচিত ছিলেন এবং তাদের যোগ্যতাও সাধারণত মৌলিক সাক্ষরতা ও ধর্মীয় প্রাথমিক জ্ঞানদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। তবে কিছু প্রতিভাবান মুয়াল্লিম নিজ যোগ্যতা ও প্রচেষ্টায় খলিফা বা অভিজাতদের গৃহে গৃহশিক্ষক বা ‘মুয়াদ্দিব’ হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার সম্মান ও সুযোগ লাভ করতেন।
বৈতনিক শিক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা ছিল খলিফা, গভর্নর ও আমির-ওমরাহদের সন্তানদের জন্য নিযুক্ত গৃহশিক্ষকতা। উমাইয়া খিলাফতকাল থেকে শুরু করে পরবর্তী শাসকেরাও তাদের সন্তানদের জন্য উচ্চশিক্ষিত ও যোগ্য গৃহশিক্ষক বা ‘মুয়াদ্দিব’ নিয়োগের প্রথা চালু রাখেন। এই মুয়াদ্দিবগণ কেবল উচ্চ বেতনই পেতেন না; বরং রাজদরবার ও সমাজে অত্যন্ত সম্মানিত এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিগণিত হতেন।
আব্বাসি যুগ: বাইতুল হিকমাহ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ
ইসলামি সভ্যতায় প্রকাশনা, অনুবাদশিল্প এবং লাইব্রেরির প্রাতিষ্ঠানিক উত্থান ঘটে আব্বাসি খিলাফতকালে, যা জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত। খলিফা আল-মানসুর কর্তৃক বাগদাদে বিখ্যাত ‘মদিনাতুস সালাম’ (শান্তির নগরী) বা গোলাকার শহর নির্মাণ এই স্বর্ণযুগের ভিত্তি স্থাপন করে। পরবর্তীতে খলিফা হারুনুর রশিদ এই নগরীতে স্থাপন করেন বিশ্ববিখ্যাত ‘বাইতুল হিকমাহ’ (জ্ঞানগৃহ)। তার সুযোগ্য পুত্র খলিফা আল-মামুন এই প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিধি বহুগুণে বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ করেন।
মধ্যযুগে ইসলামি সভ্যতায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে অভাবনীয় জাগরণ ঘটেছিল, তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এই বাইতুল হিকমাহ। এটি ছিল একাধারে একটি বিশাল লাইব্রেরি, অনুবাদকেন্দ্র এবং গবেষণা ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। এখানে তৎকালীন বিশ্বের প্রধান সভ্যতাগুলোর—বিশেষত গ্রিক, পারসিক ও ভারতীয়—মূল্যবান গ্রন্থসমূহ আরবিতে অনূদিত হয়। তবে এটি কেবল অনুবাদের কেন্দ্র ছিল না, মৌলিক গবেষণা ও জ্ঞানচর্চার এক উর্বর ক্ষেত্রেও পরিণত হয়েছিল। বাইতুল হিকমাহ বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে জ্ঞান ও চিন্তার আদান-প্রদানের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। বহু ইহুদি ও খ্রিস্টান পণ্ডিতও এখানে অনুবাদক ও গবেষক হিসেবে কাজ করতেন এবং উচ্চ সম্মানী লাভ করতেন। অ্যালগরিদমের জনক হিসেবে খ্যাত বিখ্যাত গণিতবিদ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খোয়ারিজমি একসময় বাইতুল হিকমাহর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন।

খলিফা হারুনুর রশিদের সময় থেকেই অনুবাদ সাহিত্যের পাশাপাশি আরবি মৌলিক সাহিত্যেরও প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। বিশ্ববিখ্যাত আরব্য রজনীর (আলফু-লাইলাতিন ওয়া-লাইলাতুন) গল্প ও লোককাহিনীগুলোও এ সময়েই সংকলিত হতে শুরু করে। বাগদাদের অলিতে-গলিতে গড়ে ওঠে অসংখ্য বইয়ের দোকান। জ্ঞানপিপাসু ও গ্রন্থ সংগ্রাহকরা দূর-দূরান্ত থেকে বাগদাদে পাড়ি জমাতে থাকেন। এই জ্ঞানদীপ্ত পরিবেশ ১২৫৮ সালে হালাকু খানের নেতৃত্বে মোঙ্গলদের দ্বারা বাগদাদ নগরী ধ্বংস হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
মাদরাসা ব্যবস্থার উত্থান: নিজামিয়া মাদরাসা
আনুষ্ঠানিকভাবে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয় সেলজুক সাম্রাজ্যের বিখ্যাত উজির নিজামুল মুলকের হাত ধরে। তিনি ১০৬৫ সালের দিকে বাগদাদ ও এর আশেপাশের অঞ্চলে ‘নিজামিয়া মাদরাসা’ নামে পরিচিত একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১০৯১ সালে তিনি প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ইমাম আল-গাজ্জালিকে বাগদাদের নিজামিয়া মাদরাসার প্রধান অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেন। নিজামুল মুলক শিক্ষকদের জন্য মাসিক বেতনের ব্যবস্থা করলেও ছাত্রদের জন্য শিক্ষা ছিল সম্পূর্ণ অবৈতনিক।
এই মাদরাসাগুলো প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল তৎকালীন মুতাজিলাদের গ্রিক দর্শন প্রভাবিত যুক্তিবাদ এবং শিয়া মতাদর্শের বিস্তার রোধ করে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদা-বিশ্বাসকে সুসংহত করা ও এর প্রসার ঘটানো। ফলে, মাদরাসা শিক্ষার মূল পাঠ্যক্রম কেন্দ্রীভূত ছিল কুরআন, হাদিস, ফিকহ এবং ধর্মতত্ত্বের (কালাম) উপর। এর পাশাপাশি আরবি ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র, নবী সা.-এর জীবনী (সীরাত), ইতিহাস, তর্কশাস্ত্র (মানতিক), এমনকি গণিতের মতো বিষয়গুলোও বিভিন্ন মাদরাসায় গুরুত্বের সাথে পড়ানো হতো।
জ্ঞানচর্চার দুটি ধারা: মাদরাসা ও লাইব্রেরি
ইসলামি শিক্ষার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মাদরাসা শিক্ষা মূলত ধর্মীয় জ্ঞানকেন্দ্রিক ছিল। পক্ষান্তরে, মধ্যযুগে ইসলামি বিশ্বে দর্শন ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান (যেমন: গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, রসায়ন) চর্চার যে অভাবনীয় বিকাশ ঘটেছিল, তা ছিল মূলত ব্যক্তি-উদ্যোগ নির্ভর এবং বাইতুল হিকমাহর মতো বিভিন্ন পাবলিক লাইব্রেরি-কেন্দ্রিক। বাগদাদের বাইতুল হিকমাহর আদলে মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরেও অসংখ্য সমৃদ্ধ পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়, যেমন বসরা, দামেস্ক, কায়রো এবং স্পেনের কর্ডোভা। কায়রোর ফাতেমি শাসকরা ‘দারুল হিকমাহ’ (এটি ‘বাইতুল হিকমাহ’ নামেও পরিচিত ছিল) নামে একটি বিশাল লাইব্রেরি ও শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।

এই লাইব্রেরিগুলোই হয়ে উঠেছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রধান কেন্দ্র। এখান থেকেই জন্ম নিয়েছেন অসংখ্য মুসলিম পলিম্যাথ (বহুশাস্ত্রজ্ঞ), বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, ভূগোলবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী। অন্যদিকে, মাদরাসাগুলো থেকে তৈরি হয়েছেন বিশ্ববিখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক, ফকিহ (আইনবিদ), মুহাদ্দিস (হাদিস বিশেষজ্ঞ) এবং আলিমগণ।
জ্ঞানচর্চার ধারায় ভাটা
দুর্ভাগ্যবশত, ১২৫৮ সালে মোঙ্গল আক্রমণে বাগদাদের পতন ও এর লাইব্রেরিগুলোর ধ্বংস এবং ১৪৯২ সালে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান (আন্দালুসের পতন)-এর পর ইসলামি বিশ্বে লাইব্রেরি-কেন্দ্রিক বিজ্ঞান ও দর্শনচর্চার প্রাণবন্ত ধারাটি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসে। এই ক্ষতি পরবর্তীতে আর পুরোপুরি পূরণ করা সম্ভব হয়নি, এবং এ শূন্যতাই মুসলিম বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে অনেকাংশে স্তিমিত করে দেয়।