১. কথিত ইসলাম আর ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজেশ্যনের মধ্যকার যে সংকট, সেটা আসলে বাই রূট জ্ঞানতাত্ত্বিক। আমি বেশ অনেকদিন ধরে এদেশের স্কুল সিস্টেম আর মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে তুলনা-প্রতিতুলনা করে দেখছিলাম।
মুসলিমদের ঐতিহ্যবাহী যে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা—তাতে জ্ঞানের প্রাইমারি সোর্স হলো কুরআন-সুন্নাহ, কিন্তু সেক্যুলার একাডেমিয়া, অর্থাৎ স্কুল-কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থায় জ্ঞানের প্রাইমারি সোর্স হলো যুক্তি-বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতা। এখন, এদুটো কিন্তু মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ নয়, বরং আমি বলছি প্রাইমারি সোর্সের কথা। অর্থাৎ মাদ্রাসা শিক্ষা, বা ইসলামিক একাডেমিয়ায় মানুষের আকল বা বোধবুদ্ধিকে কুরআন-সুন্নাহ থেকে কম প্রায়োরিটি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অস্বীকার করা হয় না।

সেক্যুলার একাডেমিয়ায় মানুষ জ্ঞান তৈরিতে ব্যবহার করে সায়েন্টিফিক মেথড। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণার মাধ্যমে যে নতুন জ্ঞান তৈরি হয়—সেটাই সেক্যুলার একাডেমিয়ায় স্বীকৃত। সেক্যুলার একাডেমিয়াতে ‘ইলমুল গাইব’ বা অদৃশ্যের জ্ঞান বলতে কোনো কিছু অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় না। যা আমাদের পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের ধারণযোগ্য, গাণিতিক যুক্তিবুদ্ধির অনুকূল বা অভিজ্ঞতালব্ধ নয়—তা সেক্যুলার একাডেমিয়ায় জ্ঞান নয়। কোনো কিছু জ্ঞান হয়ে ওঠার জন্য অবশ্যই সেটিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উত্তীর্ণ হতে হবে।
ট্রেডিশনাল ইসলামি জ্ঞানতত্ত্ব ফেইথ বেইজড। এখানে বিশ্বাস থেকেই সকল জ্ঞানের বিকাশ; কিন্তু সেক্যুলার একাডেমিয়ায় জ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ সূচনাবিন্দু হলো সংশয়। সংশয় ছাড়া জ্ঞান বিকশিত হয় না। এই অর্থে ধর্মীয় মৌলবাদের বেইজ হলো বিশ্বাস, আর সেক্যুলার প্রগতিবাদের বেইজ হলো সংশয়।
এইযে, আমরা আজকের পৃথিবীতে মানুষের এতএত বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষ দেখি—তার মূলে আছে পুরাতনের প্রতি সংশয়, নতুনের প্রতি অগাধ আস্থা! ইসলামে নতুনের প্রতি একধরণের নেতিবাচকতা আছে ধর্মতাত্ত্বিকভাবে, নতুন মানেই বিদআত, আর বিদআত অবশ্যই পরিত্যাজ্য। যদিও বিদআতের ব্যাপারটা শুধুমাত্র ইবাদাতের ক্ষেত্রেই নিষিদ্ধ, কিন্তু বিদআতের কনসেপ্ট সার্বিকভাবে মুসলিম ট্রেডিশনাল একাডেমিক মনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত করেছে।
২. ইসলামের স্বর্ণযুগের আলোচনায় অনেকেই গদগদ হয়ে মুসলিমদের দর্শনচর্চা এবং বিবিধ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা তুলে আনেন। অথচ এখানে সূক্ষ্ম একটা ব্যাপার এড়িয়ে যাওয়া হয়। ইসলামের স্বর্ণযুগ ধরা হয় আব্বাসী খলিফাদের আমলকে।
দেখুন, নববী যুগ বা খুলাফায়ে রাশিদুনের যুগকে কিন্তু ইসলামের স্বর্ণযুগ বলা হয় না; অথচ ইসলামিক থিওলজি অনুযায়ী মুসলিমদের প্রথম তিন প্রজন্মই ধার্মিকতার দিক থেকে শ্রেষ্ঠতর। আবার আব্বাসী আমলে যারা দর্শন ও বিজ্ঞানচর্চায় উৎকর্ষ অর্জন করেছিলেন, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, আমল ও আকিদার ব্যাপারে আছে অনেক বিতর্ক। ধর্মীয় দিক থেকে বিতর্কিত একটা অধ্যায়কে বলা হয় ইসলামের স্বর্ণযুগ, এবং যারা এটা বলেন—তারা পিয়োরলি সেক্যুলার পার্সপেক্টিভ থেকেই বলেন।
সেক্যুলার একাডেমিক মাইন্ডসেট নিয়ে কখনোই আসলে ইসলামিক থিওলজি-বেইজড শিক্ষা-পদ্ধতিকে পুরোপুরি বোঝা যায় না। আবার একজন মাদ্রাসার ফারেগের পক্ষেও সেক্যুলার একাডেমিয়াকে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব হয় না। সেক্যুলার প্রফেসররা সাবকনশাসলি হুট করেই গণিতের কোনো একটা ফরমুলা আবিষ্কার করে ফেলতে পারেন, কিন্তু মাদ্রাসার উস্তাদদের মতো তাদের কাছে জ্ঞান ইলহাম হয় না। মাদ্রাসার উস্তাদরা মাঝেমাঝে কারামাত দেখাতে পারেন, কিন্তু সেটা কখনোই কোনো সেক্যুলার প্রফেসরের মতো একাডেমিক এক্সপার্টিজ হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাবে না।
৩. আধুনিক সেক্যুলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষিত ইসলামপন্থীরা সেক্যুলার একাডেমিয়ার এক্সিলেন্সি উপলব্ধি করে ইসলামের ট্রেডিশনাল শিক্ষাক্রম আর সেক্যুলার একাডেমিয়াকে ব্লেন্ড করতে চেয়েছে। এই ব্লেন্ডিং প্রজেক্টের তাত্ত্বিকগন এর নাম দিয়েছে ‘ইসলামাইজেশন অব নলেজ’। এই তত্ত্বের উপরে ভিত্তি করে রাতারাতি দাঁড়িয়ে গেছে বিভিন্ন ইসলামিক ইউনিভার্সিটি এবং IIIT এর মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

মজার ব্যাপার হলো, এই ধরণের থিয়ো-সায়েন্টিফিক গবেষণা ও শিক্ষা পদ্ধতিতে রেফারেন্স হিসেবে কুরআন-সুন্নাহকে আনা হলেও গবেষণার কাঠামো কিন্তু ‘সায়েন্টিফিক মেথড’। এ ধরণের ‘থিও-সায়েন্স’ একজন পিয়োর সেক্যুলার একাডেমিশিয়ানের কাছে অনেকটা গোজামিলের মতো মনে হলেও কনসেপ্টটা কিন্তু সেক্যুলার একাডেমিয়ায় এক প্রকার স্বীকৃতি লাভ করেছে; আর এর মূলে রয়েছে সায়েন্টিফিক মেথডের অনুসরণ। এটা অনেকটা একজন কালামিকে (ইলমুল কালামের চর্চাকারী) দার্শনিক হিসেবে স্বীকার করে নেওয়ার মতো ব্যাপার।
যাহোক, আমরা যদি ধর্মীয় বিশ্বাসকে একপাশে রেখে শুধুমাত্র মানুষের সভ্যতাগত উৎকর্ষের কথা ভাবি, কোনো সভ্যতাকে পুরোপুরি ইউনিক বা মৌলিক বলাটা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। প্রত্যেক নতুন সভ্যতাই তার পূর্বতন সভ্যতার রূটের উপরে গড়ে ওঠে, পূর্ববর্তী সভ্যতা থেকে বিভিন্ন উপাদান গ্রহণ করেই নতুন সভ্যতা নিজেকে ডেভেলপ করে। এই যেমন মুসলিম সভ্যতা তার কথিত স্বর্ণযুগে গ্রিক ও পারসিক সভ্যতার দ্বারা ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ ও প্রভাবিত হয়েছিলো, তেমনি পাশ্চাত্য সভ্যতা তার বিকাশলগ্নে সমৃদ্ধ ও প্রভাবিত হয়েছে আরব-মুসলিম সভ্যতার দ্বারা।
সভ্যতা কখনোই শূণ্য থেকে বিকশিত হয় না। এই যে সেক্যুলার একাডেমিয়ার জ্ঞানতত্ত্বে ‘সায়েন্টিফিক মেথড’ বলে যে গবেষণা পদ্ধতির অস্তিত্ব বিদ্যমান, সেটাও মুসলিম সভ্যতা থেকে ধার করা, যা পরবর্তীতে সেক্যুলার একাডেমিয়ায় এসে আরো বিকাশ এবং স্থিতি লাভ করেছে।
কিন্তু সভ্যতার ক্রমবিকাশের এই আলোচনার মাধ্যমে কি ট্রেডিশনাল মুসলিম শিক্ষাপদ্ধতি আর সেক্যুলার একাডেমিয়ার এপিস্টেমিক পার্থক্য ঘুচানো সম্ভব? মোটেই না, কারণ এই আলোচনাটিই স্বয়ং একটি সেক্যুলার আলোচনা।
‘ইসলামাইজেশন অব নলেজ’ প্রজেক্টের আওতাধীন থিয়ো-সায়েন্টিফিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গবেষণা-পদ্ধতির কারণেই আল্টিমেটলি সেক্যুলার একাডেমিয়ারই অংশ। অন্যদিকে উপমহাদেশের কওমী মাদ্রাসাগুলোসহ ট্রেডিশনাল মাদ্রাসা শিক্ষায় ইসলামি সাবজেক্টগুলোর পাশাপাশি গণিত বা ব্যাকরণের মতো সেক্যুলার সাব্জেক্টগুলো পড়ানো হলেও শিক্ষাকাঠামোর জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিন্নতার কারণে এগুলো ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থারই অংশ।
ট্রেডিশনাল ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘আল ফিকহুল মুআমালা আল মালিয়্যাহ’ সাবজেক্টটিকে বলা যায় সেক্যুলার ফিন্যান্স ও মাইক্রোইকোনমিক্স সাবজেক্ট দুটোর ইকুয়েভ্যালেন্ট, তবু শুধুমাত্র জ্ঞানের প্রাইমারি সোর্স কুরআন-সুন্নাহ হবার কারণেই এই সাবজেক্টটিকে একটা সেক্যুলার সাবজেক্ট বলা যায় না, কিন্তু এটা একটা ইসলামিক সাবজেক্ট।
৪. মুসলিমরাও মানুষ, সেক্যুলাররাও মানুষ। জীবনধারণের জন্য মুসলিমদেরও কাজ করতে হয়, সেক্যুলারদেরও কাজ করতে হয়। তবু পার্থক্য কোথায়? পার্থক্য জ্ঞানতত্ত্বে! পরিশ্রম যতই করুক, মুসলিমরা বিশ্বাস করে—রিজিক আল্টিমেটলি আল্লাহই দেন।
ট্রেডিশনাল মুসলিম শিক্ষাপদ্ধতি আর আধুনিক সেক্যুলার একাডেমিয়ার কথা আমি যখন ভাবি, তখন বারবার আমার সূরা কাহাফে বর্ণিত মুসা আলাইহিস সালাম আর খিজির আলাইহিস সালামের গল্পটি মনে পড়ে যায়। লজিক্যালি মুসা আলাইহিস সালাম রাইট হলেও শুধুমাত্র ইলমুল গাইবের কমতির দরুন তিনি খিজির আলাইহিস সালামের কর্মকাণ্ডের প্রতি ধৈর্যধারণ করতে পারেন নি, অথচ শেষমেশ তিনি খিজির আলাইহিস সালামের কাছে হার মানেন।
সর্বগ্রাসী সেক্যুলার একাডেমিয়া, সেক্যুলার ওয়ার্ল্ডভিউ আর এর গ্লোবালাইজেশনের যুগে নিজের বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার জন্যই হয়তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ জামানার মুসলিমদের বেশিবেশি সূরা কাহাফ পড়তে বলেছেন, বিচ্যুতির পর বারবার কুরআন-সুন্নাহয় ফিরতে বলেছেন…।
আল্লাহই সর্বজ্ঞানী, তিনিই সর্বাধিক ভালো জানেন।