দুই বন্ধু বসন্তের কোনো এক সুন্দর সকালে বনে বেড়াতে গেল। চার দিকে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। দুই বন্ধুর মেজাজ তাই বেশ ফুরফুরে। হাঁটতে হাঁটতে তারা নিজেদের অতীতের অনেক স্মৃতিচারণ করতে লাগল। হাজারো স্মৃতির সমুদ্রে অবগাহন করতে করতে দুজনই বেশ আবগাপ্লুত হয়ে উঠল। জীবনের এত বছর পরেও দুই বন্ধুর মধ্যে ভালোবাসার কোনো কমতি নেই দেখে দুজনই বেশ বিমোহিত।
হাঁটতে হাঁটতে তারা বনের বেশ গভীরে চলে এলো। বনভোজনের জন্য তারা সাথে করে নিয়ে এসেছে প্রয়োজনীয় সব উপকরণ। এক বন্ধু রান্না চড়ানোর জন্য সবকিছু গোছগাছ করতে লাগল। আরেক বন্ধু আনতে গেল আগুন জ্বালানোর কাঠ। যে কাঠ আনতে গেল সে একটা মরা গাছের গুড়ির নিচের একধরনের ধাতব আওয়াজ শুনতে পেল। সে বেশ অবাক হয়ে দেখল, একটা মুখবন্ধ তামার কলসি। সে এটা দেখাতে তার অপর বন্ধুকে ডেকে আনল।

দুজনে মিলে তামার কলসির মুখটা খুলল। সাথেসাথে কলসি থেকে ধোঁয়া বের হতে লাগল। আর সে ধোঁয়া কুণ্ডুলি পাকিয়ে ধীরে ধীরে একটা দানবাকৃতির জ্বীনে রূপ নিল। যদিও দুই বন্ধুই বেশ ভয় পেয়ে গেল, কিন্তু জ্বীন তাকে মুক্ত করার জন্য দুই বন্ধুর প্রতি বারবার শুকরিয়া জ্ঞাপন করে বলল, সে তাদের পুরষ্কৃত করতে চায়। তবে জ্বীনটি সেইসাথে এক অদ্ভুত শর্ত জুড়ে দিল। প্রথম বন্ধুটি যা চাইবে, দ্বিতীয় বন্ধুটি তার দ্বিগুণ পাবে। এমন শর্ত শুনে দুই বন্ধুই চুপ মেরে গেল। তারা দুইজনই নিজের জন্য যা চাইবে—অপরজন তার দ্বিগুন পাবে, এই ব্যাপারটা কিছুতেই তারা মেনে নিতে পারল না। তাই আগ বাড়িয়ে কেউই নিজের জন্য কিছু চাইলো না।
একটু আগেই পরস্পরের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা অনুভব করা দুই বন্ধুই এখন পরস্পরের প্রতি হিংসাপরায়ণ হয়ে উঠল। অবশেষে এক বন্ধু জ্বীনকে বলল, ‘আমার এক চোখ অন্ধ, এক হাত অচল, আর এক পা খোঁড়া করে দাও।’ জ্বীন তার প্রত্যাশা অনুযায়ী তার এক চোখ অন্ধ, এক হাত অচল, আর এক পা খোঁড়া করে দিল। আর সেইসাথে অপর বন্ধুটির দুই চোখই অন্ধ হয়ে গেল, দুই হাতই অচল এবং দুই পা খোঁড়া হয়ে গেল। জ্বীন তাদের ইচ্ছা পূরণ করে ফেরার সময় বলল— ‘মনুষ্য জাতি খুবই হিংসুটে’। দুই বন্ধু অসহায় অবস্থায় বনে পড়ে রইল।
এই গল্প থেকে আমরা কী শিখলাম? হিংসুক শুধু অপরেরই ক্ষতি করে না, সবচেয়ে ক্ষতি করে নিজের। হিংসার দহন ক্ষমতা আগুনের চাইতেও বেশি। হিংসা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করেছে পরিবার থেকে পরিবার, অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এমনকি দেশ জাতিও।
গ্রামে সামান্য মৌসুমী ফল, পুকুরের মাছের ভাগ-বাটোয়ারার মতো সামান্য ইস্যু নিয়ে হয় পারিবারিক ঝগড়া, মারামারি, এমনকি খুনোখুনি পর্যন্ত। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয় ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার তাড়নায়। মানব-ইতিহাসের প্রথম খুনোখুনির পেছনেও দায়ী এই হিংসা। হাবিল-কাবিলের গল্পটি মনে আছে?
মালাকদের সর্দার আযাযীল মানুষের প্রতি হিংসাপরায়ণ হয়ে আল্লাহর হুকুম পর্যন্ত অমান্য করল। ফলে সে জান্নাত তো হারালই, পরিণত হলো অভিশপ্ত শয়তানে।
আমার থেকে কে কতটুকু বেশি পেয়ে গেল, কিংবা আমরা কতটুকু কম পেলাম, এই হিসাব কষতে কষতে আমরা জীবনের উদ্দেশই হারিয়ে ফেলি। যেন জীবনের উদ্দেশই হলো অপরের তুলনায় লাভবান হওয়া, প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা। জীবনে এমন সব বস্তুবাদী অংক মেলাতে মেলাতে কবরে পর্যন্ত চলে যাই। আল্লাহ আমাদের কাছে কী চান, ইসলাম একজন বিশ্বাসীকে কী ধরনের জীবনবোধের দিকে পরিচালিত করতে চায়—তা আমরা উপলব্ধির জায়গাতে এনে যাচাই করে দেখার ফুসরত পাই না।
অথচ আমরাই ভুপেন হাজারিকার গান মুগ্ধ হয়ে শুনি—
বলো কি তোমার ক্ষতি
জীবনের অথই নদী
পার হয় তোমাকে ধরে
দুর্বল মানুষ যদি?
…ওই তো, মুগ্ধ হওয়া পর্যন্তই!! কথাগুলো আমাদের মরমে কখনো পৌঁছে না।