আফ্রিকার সবুজ প্রান্তরে, ঘানার ধূসর মাটির কোলে, আল-হাসান আব্দুল্লাহ নামের এক দরিদ্র কৃষক তার দিনাতিপাত করতেন। জীবনের প্রতিটি বাঁকে অভাব আর কষ্টের সাথে তার ছিল নিত্যদিনের লড়াই। শরীর যখন বার্ধক্যের ভারে ন্যুব্জ, তখনও একটি স্বপ্ন তার অন্তরে অমলিন ছিল – পবিত্র কাবা শরীফে গিয়ে তিনি হজ পালন করবেন, প্রভুর দরবারে নিজেকে সঁপে দেবেন।
সামর্থ্য ছিল না, কিন্তু হাসানের হৃদয় ছিল ঈমানে পরিপূর্ণ। তাই দিনের পর দিন তিনি দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাতেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ, আমার এই দরিদ্র বান্দার হজের সফর তুমি কবুল করো। আমি যেন তোমার পবিত্র ঘর তাওয়াফ করতে পারি, তোমার প্রিয় নবীর (সাঃ) পদধূলিধন্য ভূমি দেখতে পারি, তাঁর রওজা মোবারক যিয়ারত করতে পারি, মসজিদে নববীতে সিজদা করতে পারি। ইয়া আল্লাহ, তুমি আমাকে তোমার ঘরের মেহমান হিসেবে কবুল করে নাও।’

এভাবেই আল্লাহর দরবারে মিনতি জানাতে জানাতে হাসানের জীবনের অনেকটা সময় কেটে গেল।
একদিন, তুরস্কের একটি টিভি চ্যানেলের ফিল্ম ডিভিশন তাদের ডকুমেন্টারি তৈরির জন্য ঘানাতে এলো। আফ্রিকার মনোরম পাহাড় আর জঙ্গলের ছবি ক্যামেরাবন্দী করতে করতে, পরিচালক আকাশে ড্রোন ওড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রকৃতির সুন্দর দৃশ্য ধারণ করার সময় হঠাৎ তাদের ড্রোনটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্যের মতো উড়তে উড়তে একসময় সেটি সোজা গিয়ে পড়ল বৃদ্ধ হাসান আব্দুল্লাহর উঠোনে।
আচমকা একটি সাদা রঙের অদ্ভুত বস্তু উঠোনে পড়ায় হাসান কিছুটা হকচকিত হয়ে গেলেন। হাতে নিয়ে তিনি অবাক চোখে ড্রোনটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। যন্ত্রটিকে ঘোরাতেই তার মনে এক সরল ভাবনা এলো, ‘যদি এর চেয়ে বড় একটা কিছু আমার থাকত, তবে নিশ্চয়ই আমি সেই বাহনে চড়ে মক্কায় আল্লাহর ঘরে হজ করতে যেতে পারতাম!’
অন্যদিকে, শুটিং ইউনিটের কর্মীরা তাদের হারানো ড্রোনটি খুঁজে হয়রান। পুরো দিন তন্নতন্ন করে খুঁজেও তারা সেটির কোনো সন্ধান পেল না। পরদিন ভোরের আলো ফুটতেই দলের একজন সদস্য আবার সেই এলাকায় ড্রোনটির খোঁজে বের হলেন। ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসে পৌঁছালেন হাসান আব্দুল্লাহর কুঁড়েঘরের সামনে। সেখানে গিয়ে তিনি যা দেখলেন, তাতে তার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! বৃদ্ধ হাসান তার উঠোনে দাঁড়িয়ে, সেই সাদা রঙের ড্রোনটি হাতে নিয়ে দেখছেন।
শুটিং ইউনিটের সেই সদস্য নিজের পরিচয় জানালেন। তখন আল-হাসান আব্দুল্লাহ উৎসুক হয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, আপনাদের কাছে কি এর চেয়ে বড় কোনো ড্রোন আছে, যেটাতে চড়ে আমি হজ করতে যেতে পারি?’
হাসান আব্দুল্লাহর সরল মনে লুকানো এই পবিত্র ইচ্ছের কথা শুনে সেই ক্রু-মেম্বারের হৃদয় গভীর সহানুভূতিতে ভরে উঠলো। তিনি দ্রুত ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে পুরো ঘটনা তার টিমের অন্য সদস্যদের জানালেন। হাসানের নিষ্পাপ বাসনার কথা শুনে তারাও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। দেরি না করে তারা আল-হাসান আব্দুল্লাহর গল্প নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে শেয়ার করলেন। মুহূর্তের মধ্যেই সেই গল্প পুরো তুরস্কে ছড়িয়ে পড়ল, যেন কোনো অলৌকিক ঘটনা। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে গণ্যমান্য ব্যক্তি পর্যন্ত সবাই এই দরিদ্র কৃষকের স্বপ্ন পূরণের জন্য আলোচনা করতে শুরু করলেন।
একসময় এই হৃদয়স্পর্শী কাহিনী তুরস্ক সরকারের দৃষ্টিগোচর হলো। তুর্কি সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কালবিলম্ব না করে তাদের নিজস্ব অর্থায়নে আল-হাসান আব্দুল্লাহকে প্রথমে বিমানে করে তুরস্কে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলো। এরপর সেখান থেকে তার বহুদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণের সকল আয়োজন সম্পন্ন হলো।
অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। আল-হাসান আব্দুল্লাহ প্রথমবারের মতো দেখলেন পবিত্র কাবা শরীফ। বিস্ময় আর শ্রদ্ধায় তার চোখ ভিজে উঠলো। দুর্বল শরীর নিয়েও তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন কালো গিলাফের পবিত্র ছায়ায়। তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আজ সত্যি হলো, আল্লাহর রহমত যেন tangible রূপে তার সামনে এসে ধরা দিল।
(…সত্য ঘটনা অবলম্বনে।)