সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বহুদূরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। কী জানি কী ভাবনায় বিভোর হয়ে ওঠে তার মন প্রাণ। তার হৃদয়ের গভীরে বেজে ওঠে বিষাদের বাঁশি। দিন শেষে সকল আনন্দের পরে এক অসীম শূন্যতা তাকে ঝেঁকে ধরে। তার মনে হতে থাকে- অসীমের মাঝে তার স্থান আর গুরুত্ব কতটা নগণ্য, কতটা তুচ্ছ।
অন্যসব দিনের মতো এই গোধুলিতে সে এসে দাঁড়ালো তার চেনাজানা বারান্দায়। ছোট-ছোট ফুলের টবে ফুটে আছে নাম না জানা কিছু অর্কিড আর কিছু লতানো ফুল। বারান্দায় ফুলগুলো সে নিজের হাতে লাগিয়েছে খুব যত্ন করে। সে যখন বারান্দায় এসে দাঁড়ায়- তার একাকিত্বের সঙ্গী হয় এই ফুলগুলো। সে ফুলের সাথে নিজের কষ্টগুলোকে ভাগাভাগি করে নেয়। অনেক অনেক কথা হয়- হৃদয় গহনে লুকানো সে কথাগুলো কেউ কখনো জানবে না।

ফুলের সাথে কথা বলার একটা সুবিধা হলো- ফুল শুধু শুনে যায়। মাঝপথে বাধা দেয় না। থামিয়ে দেয় না। কিম্বা আনাড়িদের বলেবলে তার মূল্যবান কথাগুলোকে মূল্যহীন করে দিতে পারে না এই ফুলেরা। এই ফুলগুলোকে সে ভালোবাসে। হৃদয় নিংড়ে সে তার ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করে ফুলগুলোর কাছে। বিনিময়ে এই ফুলেরা কোনো সাড়া না দিলেও অন্তত ভালোবাসাকে হেলায় ফেলে দিতে তো পারে না।
সন্ধ্যা নেমে আসে। সে জানালার পাশ থেকে সরে এসে তার অতি পরিচিত পড়ার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ায়। এরপর বসে পড়ে চেয়ারে। পাশের রূম থেকে অসুস্থ বাবার গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। মা হয়তো নামাজে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ কান্নায় দু’চোখ ঝাঁপসা হয়ে এলো তার। নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো তখন। দুঃখ- ভারাক্রান্ত ভঙ্গুর কাঁধ আর কত বোঝা সইবে?
বাইরে থেকে হঠাৎ পাড়ার ছেলেদের সোরগোল শোনা গেলো –
“ঐ যে দেখ,
নতুন ঈদের চাঁদ উঠেছে,
পাড়ায় খুঁশির বান লেগেছে।”
সে হঠাৎ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। আহ! কত সুন্দর ছিলো শৈশবের উচ্ছলতা ভরা সেই দিনগুলো। সে সোনালী দিনগুলোর সেই রূপালী সময়েরা যেন স্বপ্নের মতোই হারিয়ে গেলো। এই যে নতুন ঈদের চাঁদ উঠেছে – কিন্তু মনে আনন্দ কই? সেই ছোটবেলায় কত আনন্দই না ছিলো! পাড়ায় তখন এত উঁচু-উঁচু দালান ছিলো না। ঈদের নতুন চাঁদকে তখন দালানের ছাদ থেকে দেখা লাগতো না।
তখন ছিলো বিস্তীর্ণ মাঠ। আজকের পাড়ার বড় ছেলেমেয়েরা তখন প্রাণোচ্ছল কিশোর-কিশোরী। তাদের চোখে ছিলো রাজ্যের স্বপ্ন। তাদের স্বপ্নের ব্যপ্তিকে তখন বহুগুণে বাড়িয়ে দিতো চিকন সুতোর মতো চাঁদ আর আকাশের তারকারাজি। চারদিকের কিশোরদলে কী যে হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দ ছড়িয়ে পড়তো! তখন মোবাইলফোন ছিলো না, ছিলো না বাহারী সব ল্যাপটপ কিম্বা স্মার্টফোন। কিন্তু সবার মুখে লেগে থাকতো রাজ্যের হাসি। চিকন সুতোর চাঁদ টুপ করে ডুবে যাবার পর লক্ষকোটি তারকারাজির দিকে বিস্মিত হয়ে চেয়ে থাকা কিশোর দল মসজিদে গিয়ে স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানাতো এমন সুন্দর একটা জীবন ও স্বপ্নময় পৃথিবীর জন্য।
সে স্মৃতির অতলে আরো বেশি তলিয়ে যেতে থাকে। বাবা সেসময় চাঁদরাতে হঠাৎ লাল টুকটুকে জামা কিনে এনে দিয়ে বলতেন- “নে রে মনা, এটা তোর জন্য।” তখন যেন বিশ্বজয়ের আনন্দ হতো মনে। পাড়ার ছেলেমেয়েদের তখন হৃদয়ে আনন্দের প্লাবন। কিন্তু কী জানি কোন গোপনীয়তায় পরিবেশ গম্ভীর হয়ে পড়তো, এই বুঝি আমার নতুন জামা কেউ দেখে ফেলে! তাহলে যেন ঈদটাই মাটি।
তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আজকের শেষ ইফতারিতেও বাবার সাথে একসাথে খাওয়া হয় নি। মা এসে টেবিলের উপর ইফতারি রেখে গেছেন। কিন্তু খাওয়া হয় নি। এখনো পড়ে আছে স্ব-স্থানে। যখন চারদিকে মাগরিবের আজান ছড়িয়ে পড়েছে সুমধুর রবে- তখনো বাবার কোনো চানচল্যতা নেই।
সে উঠে দাঁড়ালো। ড্রয়ার থেকে দু’টো প্যাকেট বের করলো। তারপর ঢুকলো বাবা-মায়ের রূমে। বাবার মাথার কাছে বসে থাকা মায়ের হাতে একটা প্যাকেট গুজে দিলো সে। প্যাকেটের ভেতরে একটা সবুজ রঙে টাঙ্গাইল শাড়ি। মা একটু মলিন হেসে প্যাকেটটি হাতে নিলেন। সে বাবার খুব কাছে গিয়ে বাবার মাথার কাছে অন্য প্যাকেটটি রাখলো। প্যাকেটে ছিলো বাবার জন্য কেনা সাদা পাঞ্জাবী আর টুপি। সে বাবার কানের কাছে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো- “বাবা, ঈদ মোবারক!”
বাবার চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু বেরিয়ে এলো। আনন্দের অশ্রু। সে আনন্দ ঈদের জন্য নয়, সে আনন্দ সন্তানকে ক্ষণিকের জন্য কাছে পাওয়ার আনন্দ। কত কম বয়সেই না এক বড় দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে ছেলেটাকে। টিউশনির টাকায় সংসার চালিয়েও বাবা-মাকে ঈদের উপহার দিতে ভোলে নি। মা-ও নিরবে চোখের অশ্রু ফেলতে লাগলেন।
বাইরের চাঁদ দেখার উচ্ছাস এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই এতক্ষণে মেতে উঠেছে ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জারে। আজ আর তারা দেখার সময় কারো নেই।