গানের কথাগুলো যেমন মাদকতা দিয়ে মানুষের হৃদয়কে ক্ষণিকের জন্য আচ্ছন্ন করে, বাস্তব জীবনে সে মাদকতার প্রভাব বোধহয় খুব ক্ষণস্থায়ী হয়। হৃদয়ের পরম আকুতিগুলো, তোলপাড় করা অনুভূতিগুলো যেভাবে গানের কথায় ও সুরে উপস্থাপিত হয়- সেভাবে তো জীবনে উপস্থাপিত হতে পারে না! জীবন বিষন্নতায় ভরা, জীবন নির্মম। গানের মোহজাগানিয়া সুর আর দ্যোতনা জীবনে থাকে না। যে ভালোবাসা গানে ব্যক্ত হয়, তা জীবনে থাকে না।
গানের কথাগুলো মানুষের হৃদয়ের বাসনাকে ব্যক্ত করে, সুরগুলো হৃদয়ের রিদমকে উপস্থাপন করে। কিন্তু জীবন তো ঠিক আমাদের অন্তরের চাওয়ার মতো হয় না। জীবন জীবনের মতো। জীবনের ভালোবাসাগুলো খুবই একপেশে হয়। অনুভূতিগুলোর ম্যাচিউরিটি আসে বারংবার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর। মানুষ তখনই ম্যাচিউর হয়, যখন ম্যাচিউর হওয়া ছাড়া তার হাতে অন্য কোনো অপশন থাকে না। কিন্তু গান তো হৃদয়ের নিরেট ইম্ম্যাচিউরিটিকে ব্যক্ত করে! মানুষ গানকে এজন্যই ভালোবাসে, কারণ গানে ম্যাচিউর হওয়ার মতো বালাই থাকে না, কৃত্রিমতা থাকে না।

গান হৃদয়ের উথাল-পাতাল আকুতিকে ধারণ করতে পারে, কিন্তু জীবন পারে না। জীবনে প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে যেতে হয়, সামাজিক হতে হয়, কৃত্রিম লোকাচারী হতে হয়। মানুষকে জীবনের নাট্যমঞ্চে প্রতিনিয়তই অভিনয় করে যেতে হয়। যে অভিনয়ে যতবেশি দক্ষতা দেখাতে পারে ততই সে ম্যাচিউর হয়, ততই ভালোবাসার স্থানটুকু ছোট হতে থাকে, আর ততই ইগোর জায়গাটা বড় হতে থাকে।
ভালোবাসার সবটুকুতো গানেই ব্যক্ত হয়ে গেছে, তাই জীবনের ভালোবাসাটা ঠিক গানের মতো অতটা গভীর আর আন্তরিক হয় না। একই ছাদের নিচে, একই বিছানায় ঘুমিয়ে তাই স্বামী হওয়া যায়, প্রেমিক হওয়া যায় না; স্ত্রী হওয়া যায়, প্রেয়সী হওয়া যায় না। মেয়েটি একই বিছানায় স্বামীর সাথে থেকেও কোন এক স্বপ্নপুরুষের কল্পনায় বিভোর থাকে, যে পুরুষটিকে সে তার স্বামীর মাঝে খুঁজে পায় না। ছেলেটি স্বপ্নের রাজকন্যাটির খোঁজ পায়না তার স্ত্রী-তে, অতৃপ্ত হৃদয় নিয়ে ছেলেটি হয়তো উথাল-পাতাল আবেগী কোনো প্রেয়সীর কথা ভাবে।
প্রেম, সত্যিকারের প্রেম- আসলে কোথায় থাকে? আমার ধারণা তা কেবল গানেই থাকে।
“না উমুর কি সীমা হো, না জনম কা হো বান্ধান
যাব পেয়ার কারে কো-ই, তো দেখে কেবাল মান”
না, শুধু মন দিয়ে জীবনে চলে না। জীবনে টাকাকড়ি লাগে, অর্থবিত্ত লাগে, সামাজিক মর্যাদা লাগে; এগুলো ছাড়া ভালোবাসা জোটে না। ভালোবাসা খুবই তরল জিনিস, জীবন সে ভালোবাসাকে ধারণ করতে পারে না। কেবল গানের কলিতেই হয়তো ভালোবাসা এতটা প্রকাশিত হতে পারে।