আমি এক পরাবাস্তব জগতে বাস করি, যে জগতে আমি খুবই একা, নিঃস্ব। আমার বয়েস বেশ অল্প হলেও, এই অল্প বয়সেই আমি কেমন যেন বুড়িয়ে গেছি। আমার চিন্তাভাবনাও হয়ে গেছে বুড়োদের মতো। সদ্য পেরুনো কৌশোরের চানচল্য আর নব-যৌবনের উন্মাদনা—এর কোনোটাই আমাকে তাড়িত করে না। আমি তাড়িত হই আমার জীবনের বাস্তবতায়। যে বাস্তবতায় বাস করে আমার মা, একাকী ভিষণ্ণ এক মহিলা; আমার বড়ভাই, যে নেশা করে এসে প্রতি রাতে তার স্ত্রীকে পেটায়; দ্বিতীয় বিয়ে করা আমার জুয়াড়ি বাবা, যিনি প্যারাসাইটের মতো আমাদের দুই ভাইয়ের উপরে ভর করে বেঁচে থাকেন; আর আমাদের বাসার দোতলায় থাকা মায়াবতি মেয়ে রিমি, যে ছিলো আমার খেলার সাথী।

আমি শিশু অবস্থায় ডিভোর্স ছাড়াই আমার বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আমার এক চাচা বাবার অনুপস্থিতিতে আমার মায়ের ঘরে প্রবেশ করে বিভিন্ন নোংরা আচরণ করতো। মা আমার বাবাকে অনেকবার বিষয়টা অবগত করলেও বাবা সেটা বিশ্বাস করতেন না, মনে করতেন মা-ই মিথ্যা বলছে। এ নিয়ে প্রায়ই আমাদের বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া হতো। আমি তখন কোলের শিশু।
একদিন মা রাগ করে আমাকে আর আমার বড়ভাই শিহাবকে নিয়ে ওনার বাবার বাড়ি চলে গেলেন। বাবা আমার মাকে নিতে আসেন নি, বরং জেদের বসবর্তী হয়ে উনি অন্য আরেক মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেন। সে থেকেই আমাদের দুই ভাইয়ের বাবাহীন বেড়ে ওঠা।
মা আমাদের নিয়ে তার বাবার বাসায় বেশিদিন থাকেন নি। ওনার কাছে কিছু জমানো টাকা ছিলো। সেই টাকাকে সম্বল করে আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে মা ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে তিনি বাসা ভাড়া নেন। আর ছোট একটা কাপড় ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা দিন দিন বড় হতে শুরু করলো। আমার মায়ের সাথে কয়েকজন আন্টি পার্টনার হয়ে একটা রেডিমেড গার্মেন্টস কোম্পানি দাঁড়া করালেন। আমাদের নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে নিজেদের ব্র্যান্ডের টি-শার্ট, পাঞ্জাবী, ফতুয়া তৈরি হতো। মা ব্যবসার কাজে অনেক ব্যস্ত থাকতেন।
আমরা দুইভাই নিজেদের মতো করে বেড়ে উঠছিলাম। টাকার কষ্ট আমরা কখনো অনুভব করি নি। কিন্তু একটা ব্যাপারেই আমাদের কষ্ট ছিলো। আমরা ছিলাম পিতৃ-স্নেহ ও শাসন থেকে বঞ্চিত। মায়ের ব্যস্ততার কারণে মাকেও ঠিকঠাক কাছে পেতাম না। ফলে যা হবার তাই হলো। আমার বড়ভাই শিহাব বাজে বন্ধুদের আড্ডায় পড়ে নেশায় জড়িয়ে পড়ে; মাদক ও জুয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে যায়। মাদক আর জুয়ায় আসক্ত হয়ে ভাইয়া জলের মতো টাকা নষ্ট করতে থাকে। মা যতদিনে ব্যাপারটা ধরতে পারেন, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
মা শিহাব ভাইয়াকে আসক্তি থেকে বাঁচানোর উপায় হিসেবে ওকে বিয়ে করিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়। বিয়ের পরে ভাইয়া নেশা করে এসে রাতে বউ পেটাতেন। এরপর ঘুমিয়ে পড়তেন। ভাবী মাঝেমধ্যেই মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন। মাঝেমধ্যে মায়ের সাথে ঝগড়াও লেগে যেতেন।
আমি ভাবীকে দোষ দেই না। কোনো মেয়েই আমাদের এমন কষ্টনীড়ে বাঁচতে পারবে না। ভাবী এভাবে প্রায় বিনা দোষে শাস্তি ভোগ করে যেতে লাগলেন। এসব দেখে শুনে আমার সহ্য হতো না। আমি মাঝেমধ্যে আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম।
এই যন্ত্রণা ভরা জীবনে আমি এক চিলতে শান্তি পেতাম রিমির কাছে গিয়ে। সে ছিলো আমার ছেলেবেলার খেলার সাথী। রিমি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। রিমির বাবাও আমাকে বেশ পছন্দ করেন। আমি ওনাকে আঙ্কেল ডাকি। একদিন আঙ্কেল বললেন—আশিক, তুমি চাইলে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে পারো। শুনে আমি বেশ লজ্জা পেলাম। আমি বললাম—আঙ্কেল, আমরা তো এখনো বেশ ছোট। আমরা বেশ ভালো বন্ধু। রিমিকে বিয়ের কথা কোনোদিন ভাবি নি।
সত্যি কথা হলো—রিমিকে বিয়ে করার কথা আমি ভাবতে পারি না, যদিও তাকে প্রচন্ড পছন্দ করি। ওকে আমার জাহান্নাম হয়ে ওঠা পরিবারে এনে কষ্টের মধ্যে ফেলতে চাই না। যাকে প্রচণ্ড ভালোবাসা হয়, তার কষ্ট সহ্য হবার নয়। রিমিও আমাকে বেশ পছন্দ করে। আমি বুঝতে পারি। কিন্তু কিছু বলি না। থেকে যাক না, এতটুকু সীমানা। সে জীবনে সুখী হোক, এটাই চাই!
হঠাৎ করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়লো। আমাদের কলেজও বন্ধ হয়ে গেলো। আর এরপরই আমার বাইক এক্সিডেন্ট হলো। টানা অনেকদিন হসপিটালে থাকতে হলো আমাকে। এরপর আমি পড়াশোনাও একপ্রকার ছেড়ে দিই। ভাইয়ার এক বন্ধুর প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করি। মেস-বাসায় উঠি। আমি চাইছিলাম জীবনকে আবার নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে। আল্লাহ কখনো আমাদের অর্থকষ্টে ফেলেন নি। তবু আমি নিজের খরচ যাতে নিজেই চালাতে পারি, সেই চেষ্টা করতে লাগলাম। কাজের মধ্যে থাকলে পরিবারের অসহনীয় চিন্তাভাবনা থেকে নিজেকে ভুলিয়ে রাখা যাবে।
আমার বাবার নিজের কোনো উপার্জন ছিল না। মাঝেমধ্যে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বাবা আম্মুর কাছ থেকে টাকা আদায় করতেন। তার দ্বিতীয় পরিবারের মাসিক খরচও আমরা দুই ভাই চালাতাম। তিনি কেন আমাদের বাবা হয়েও আমাদের প্রতি বাবার দায়িত্বটা ঠিকমতো পালন করেন নি, সেটা কখনো জানতে চাই নি। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে করে খুব, কোন অপরাধে তিনি আমাদের এভাবে বঞ্চিত করেছেন! এ-সময়ে এসে আমি বাজে আড্ডায় জড়িয়ে পড়ি। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সিগারেট-সহ বিভিন্ন ধরণের মাদক নিতে শুরু করি। যেহেতু আমি বাসায় না থেকে মেসে থাকতাম—আমাকে বাধা দেয়ার মতো কেউ ছিলো না।
একদিন বাবা এলেন আমাদের ঢাকার বাসায়। মায়ের সাথে কিছু একটা নিয়ে বেশ কথা কাটাকাটি হলো বাবার। বাবা বেরিয়ে যাবার পরই মা স্ট্রোক করলেন। আমরা মাকে সাথেসাথে হসপিটালে নিয়ে গেলাম। মাকে কিছুদিন হসপিটালে থাকতে হলো। বিভিন্ন টেস্ট শেষে জরুরী কিছু সার্জারি করতে হলো। জলের মতো টাকা খরচ হলো। আমাদের পোশাক তৈরির ফ্যাক্টরি বিক্রি করে দিতে হলো। এরপর অনেক কিছুই খুব হঠাৎ ঘটে গেলো। বাবা আসলেন হসপিটালে মাকে দেখতে। ভাইয়া রেগে গিয়ে বাবার কলার চেপে ধরলো। বাবা কিছু না বলে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে গেলেন। সেদিন আমার কী হলো বলতে পারি না, বাসায় গিয়েই অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেললাম।
আমার যখন জ্ঞান ফেরে, তখন আমি হসপিটালে। পাশে বসে ছিলেন ভাইয়া-ভাবী আর রিমি। রিমির চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছিলো। আমি কিছু বললাম না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে সবার দিকে চেয়ে থাকলাম। ভাইয়া, ভাবী আর রিমির অসহায় চাহনী দেখে তখন আমার মনে হলো—এদের জন্য আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। শুরু করতে হবে নতুন জীবন।
মা এবং আমি দুজনেই হসপিটাল থেকে ফিরলাম। মায়ের শরীর বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। মা মাঝেমধ্যে বিছানায় শুয়েশুয়ে কাঁদেন। একদিন মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “বাবা, তুই কী করে পারলি এভাবে এতগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলতে? তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কী করে বাঁচতাম? আমি তো অনেক আগেই মরে যেতাম, শুধু তোদের কথা মনে করে আমি বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পাই”।
মায়ের কথা আমি চুপচাপ শুনে গেলাম। মনেমনে বললাম, “মা, ভেবো না। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি সব ঠিক করে দেবো। তুমি শুধু দোয়া কোরো”।
আমি ধীরেধীরে সিগারেট ও মাদকের নেশা থেকে বেরিয়ে এলাম। মনেমনে শপথ করলাম, কাজের পাশাপাশি আমি আমার পড়াশোনাও চালিয়ে যাবো। আমার বড় বোনের মতো ভাবীকে যেন ভাইয়া আর অত্যাচার করতে না পারে—সে জন্য ব্যবস্থা নেবো। বাবার সাথে ভাইয়ার সম্পর্ক আবার ঠিকঠাক করে দেবো। মাকে দেখে শুনে রাখবো।
আর বাকী থাকে রিমি। সে আমার দুঃখী জীবনে থাকা ছোট্ট এক-চিলতে প্রশান্তি। এই প্রশান্তিকে আমি কখনো হারাতে দেবো না। তাকে হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখবো।