চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে আজকাল বাংলাদেশে অনেক চর্চা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন প্রকল্প ‘এক্সেস টু ইনফরমেশন’ কর্তৃক যে রিসার্চ হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে- ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশনের কারণে অচিরেই ৫.৫ মিলিয়ন, অর্থাৎ প্রায় ৫৫ লক্ষ চাকরি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পুঁজিবাদী ধ্যান ধারণা থেকেই হোক আর প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলেই হোক, শিল্প মালিকরা দিনদিন আরো বেশি মেশিন নির্ভর হচ্ছে, আরো বেশি অটোমেশনের দিকে ঝুঁকছে। এতে করে উৎপাদন যেমন কয়েকগুণ বেড়েছে, তেমনি উৎপাদন খরচ কমেছে আশাতীত। কিন্তু এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আমাদের শ্রমবাজারে।
প্রথম শিল্পবিপ্লবের শুরু মূলত বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের ফলে ইউরোপীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা আর শিল্প-উৎপাদনে আসে আমূল-পরিবর্তন। প্রান্তিক কৃষিজীবীরা ধীরেধীরে শহরমূখী হতে থাকে। ব্যপক ভাবে গড়ে উঠতে থাকে অসংখ্য শিল্প-কলকারখানা। বিদ্যুতের আবিষ্কার নিয়ে আসে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের ফলে ইঞ্জিনের কার্যকারিতা আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। উৎপাদন বাড়ে কয়েকগুণ। পেশাগত শিক্ষার পাশাপাশি কর্মীদের কারিগরি দক্ষতা অর্জন অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

সামান্তপ্রথার উচ্ছেদ আর শিল্পবিপ্লবের দরুন দু’টো নতুন শ্রেণির উদ্ভব ঘটে; শ্রমিকশ্রেণি এবং মালিকশ্রেণি। এই শ্রেণিগতবৈষম্যের কারণে ইউরোপে জন্ম লাভ করে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার। শিল্পবিপ্লবের সুবিধাভোগীদের বলা হতে থাকে বুর্জোয়া, আর বৈষম্যের শিকার শ্রমিকশ্রেণি পরিচিত হয় প্রলেতারিয়েত নামে। সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণাকে পশ্চিম ইউরোপ তাদের কলোনিয়াল শক্তির জোরে রুখে দিতে পারলেও পূর্ব ইউরোপ ঘটে যায় শিল্পবিপ্লবের প্রতিবিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে গোটা পূর্ব ইউরোপে ক্ষমতাশীন হয়ে হয়ে ওঠে সমাজতন্ত্রীরা। তারা কৃষিকে পূণরায় সম্মানজনক জীবিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে, স্টেট ওউনড প্রোডাকশন সিস্টেম চালু করে। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক ও প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার দরুন সোভিয়েত সরকার কতটুকু সমাজতান্ত্রিক গালবুলির বাস্তবায়ন করতে পেরেছে তা ইতিহাসবিদরাই ভালো বলতে পারবেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর অস্থিতিশীল বিশ্বে পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের প্রতিযোগিতার দরুন শুরু হয় কোল্ড ওয়ার অথবা শীতলযুদ্ধ। আর কোল্ড ওয়ারের হাত ধরে বিশ্বে ঘটে যায় তৃতীয় শিল্পবিপ্লব।
অটোমেশন, কম্পিউটার আর ইন্টারনেট ছিলো তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রধানতম সাফল্য। এসময়ে মারণাস্ত্র আর বিস্ফোরকের পাশাপাশি অচিন্তনীয় উন্নতি লাভ করে রকেট সায়েন্স। মানুষ পৃথিবীর আকাশসীমা পার করে জয় করে নেয় চাঁদের মাটি। কলকারখানার স্বয়ংক্রিয় মেশিন আর যোগাযোগ প্রযুক্তির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির ফলে বিশ্বায়নের সূচনা হয়। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের উত্থানের ফলে সমাজতন্ত্র পরাজয় বরণে বাধ্য হয়। অবসান হয় শীতলযুদ্ধের।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আগমনীতে যেসব জিনিস বারবার সামনে আসছে সেগুলো হলো Internet of Things (IoT), Artificial Intelligence (AI), Augmented Reality, Mass automation ইত্যাদি। কিছুদিন আগেই গুগল কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসির কথা ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এ তাদের যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে- তাকে তারা নাম দিয়েছে কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি। অদূর ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের উত্থানের মাধ্যমে হয়তো সূচনা হবে পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের।
এবার শ্রম বাজারের কথায় আসি। এতএত শিল্পবিপ্লবের পরেও শ্রমিকদের দুঃখ কমে নি, বরং বেড়েছে। শিল্প মালিকরা আগে যেসব কাজ শ্রমিকদের দিয়ে করাতেন তা এখন খুব সহজেই বিভিন্ন রোবটিক মেশিন দিয়ে করাতে পারছেন। এতে শিল্পমালিকদের উৎপাদন খরচ বহুগুণে কমে আসলেও সবচাইতে অসুবিধায় পড়েছে শ্রমজীবীরা। বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল আছে এই শ্রমিক শ্রেণির কল্যানে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের সুলভ শ্রমশক্তি আর বিদেশে থাকা অদক্ষ/দক্ষ শ্রমিক প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের টাকায় সচল আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। মাস অটোমেশনের ফলে এই শ্রমিকরাই সবার আগে চাকরি হারাবে। ফলে অল্পকিছু ধনী বিত্তশালী লোক আরো ধনী হবে, আর গরীবরা আরো গরীব হবে।
তৃতীয় বিশ্বের সরকারগুলো মূলত ধনীদের টাকা ও সমর্থনের জেরে নিজেদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে পারে। তাই তারা সমাজের ধনীদের তেমন একটা ঘাটাতে চায় না। ফলে সরকারের শ্রমিকবান্ধব পলিসি গ্রহণ কিম্বা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। আমরা যদি এখনো নলেজ ওয়ার্কার এবং ফিজিক্যাল ওয়ার্কারদের (শ্রমিক) মাঝে বেতন বৈষম্যের কথা চিন্তা করি তাহলে খুবই অবাক হবো। এদেশে বর্তমানে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বর্তমানে প্রায় সাড়ে আট হাজার টাকা। কিন্তু গার্মেন্টস মালিকরা অনেকসময় তাও ঠিকমতো আদায় করতে চায় না। অথচ গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির বেতনভুক্ত একেকজন নলেজ ওয়ার্কারদের (বুর্জোয়া) বেতন দেড় থেকে দুই লক্ষাধিক কিম্বা তারও বেশি। আর শিল্পমালিকদের রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠার কথা বরং না বলি। যে শ্রমিকদের রক্ত-ঘামে অর্জিত হয় মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা, শ্রমিকরা তার ন্যায্য হিস্যার সিকিভাগও পায় না।
তাই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রধান সুবিধাভোগী যে শিল্পমালিকরাই হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তনে কোনো সরকারি উদ্যোগ না নেয়া হলে অচিরেই তাদের ভাগ্যে নেমে আসতে পারে গুহাবাসীর অন্ধকার। বাংলাদেশে কীভাবে এই শিল্পবিপ্লবকে মোকামেলা করা হবে তা নিয়ে সরকার যদিও বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে- তা এখনে আলো-আঁধারিতে দোল খাচ্ছে। ৫৫ লাখ চাকরি যদি সত্যিই বিলুপ্ত হয়- তাহলে সে চাকুরেরা কীভাবে নতুনভাবে শ্রমবাজারে আবার উঠে আসবে তা নিয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা সরকার কিম্বা বিশেষজ্ঞ মহলের তেমন একটা নেই বলে মনে হয়। গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে মাস অটোনেশন হলে তখন আর পোশাক উৎপাদনে পোশাক-শ্রমিকের দরকার হবে না। মধ্যপ্রাচ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে অচিরেই দক্ষিণ এশীয় শ্রমিক শ্রেণির চাহিদা এবং কাটতি দু’টোই কমে যাবে।
নগরায়ন আর অধিক জনসংখ্যার ফলে বাংলাদেশের কৃষিজমি দিনদিন আরো অপ্রতুল হচ্ছে। ফলে এদেশের কৃষি-বিজ্ঞানের যতই উন্নতি হোক না কেন, কৃষিকাজের উপযুক্ত আওতা ও পরিধি দিনদিন কমতেই থাকবে। উপযুক্ত দক্ষতা ও কারিগরি শিক্ষা অর্জনের জন্য যে খরচ- তা বহনের মতো সামর্থ্য এদেশের বেশিরভাগ দরিদ্র আর নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারেরই নেই। এরপর আসা যাক ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রসঙ্গে। একে তো নিম্নআয়ের মানুষদের বিনিয়োগের সামর্থ্য প্রায় নেই বললেই চলে, তারউপর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে এসব ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প এবং সেখান থেকে উৎপাদিত হওয়া পন্য অচিরেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। তাছাড়া নানান রাজনৈতিক অস্থিরতা, রোহিঙ্গা সংকট কিম্বা ভারতে চলমান এনআরসি’র ফলে সেখান থেকে বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে যদি বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে পুশ করা হয়- তবে আমরা যে দীর্ঘ মেয়াদি সংকটে পতিত হবো তা বলাই বাহুল্য। আর সে সংকট কাটিয়ে উঠতে আমাদের লেগে যাবে যুগের পর যুগ।
পৃথিবীর সুবিধাভোগী আর সুবিধাবঞ্চিত কিম্বা ধনী আর দরিদ্র দেশগুলোর দিকে তাকালে যে চিত্র আমরা পাই তাতে করে মনে হয় আমরা যেন কোন এক প্যারালাল ইউনিভার্সে বসবাস করছি। আমাদের তৈরি করা সিস্টেম সমস্যার সমাধান না করে বরং ক্ষেত্রবিশেষে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। প্রতিকার তাহলে কী? আমার মতো চুনোপুঁটি হয়তো কোনো সমাধান দিতে পারবে না। তবে আমাদের সরকারগুলো প্রথমে জনগণের সরকার হয়ে ওঠাটা জরুরি। জীবন তো একটাই, তাই পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের একটা সচ্ছল ও নিরাপদ জীবন প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে। আমাদের সিস্টেমে গরীবদের গরু মেরে তাদের জুতো দানে সন্তুষ্ট রাখার নীতিই অনুসরণ করা হয়! এতে করে আমরা শেষমেশ কাকে ঠকাচ্ছি? মানবতাই আমাদের কাছে হারছে বারবার।