আপনারা কি এরিস্টটল, প্লেটো আর সক্রেটিসের নাম শুনেছেন? এই তিনজনই মূলত ওয়েস্টার্ন ফিলোসফির জন্ম দিয়েছেন। তো, প্লেটোর একটা বিখ্যাত থিয়োরি আছে, যাকে বলা হয় ‘থিয়োরি অব আইডিয়ালিজম & রিয়েলিজম’। এই ‘থিয়োরি অব আইডিয়ালিজম & রিয়েলিজম’ সম্পর্কে আমি প্রথম জেনেছি একটা সপ্তাহিক লার্নিং সেশনে। কাউসার স্যার নিয়েছিলেন সেশনটি। স্যার প্লেটোর আইডিয়ালিজম আর রিয়েলিজম তত্ত্বের উদাহরণ দিতে গিয়ে বললেন- একজন কাঠমিস্ত্রী যখন একটি নিখুঁত চেয়ার বানানোর কথা ভাবে, সে কল্পনায় একটা চেয়ারের ছবি এঁকে ফেলে। এরপর সে কাঠ খোদাই করে কল্পনার চেয়ারটার বাস্তব আকৃতি দান করে। তার বাস্তবে তৈরি করা চেয়ারটা কিন্তু কল্পনার চেয়ারটার মতো অতটা নিখুঁত হয় না।

এখানেই আইডিয়ালিজম আর রিয়েলিজম বোঝার ব্যাপার। যা কাঠমিস্ত্রীর কল্পনায় আছে- সেটা একটা আইডিয়াল এবং নিখুঁত চেয়ার। কিন্তু চেয়ারটা বাস্তবে রূপদানের পর সেই রিয়েল চেয়ারটা কল্পনার আইডিয়াল চেয়ারের মতো নিখুঁত হয় না বলেই সেটাকে আইডিয়াল চেয়ার বলা যায় না।
এবার পুরো ব্যাপারটাকে আরেকটু বিশ্লেষণ করা যাক! প্লেটো বলেছেন কাঠমিস্ত্রীর কল্পনার সেই আইডিয়াল চেয়ারই সত্য। আর বাস্তবে তৈরি করা চেয়ারটা যেহেতু আইডিয়াল হতে পারে নি, তাই সেটা সত্য থেকে তিনহাত দূরে অবস্থান করে। অর্থাৎ আমাদের কল্পনার কিম্বা বোধের জগতকে প্লেটো সত্য বলেছেন, আর দৃশ্যমান জগতটা ঠিক ততটা সত্য মনে হয় নি তাঁর কাছে। সৃষ্টিতত্ত্বের আলোচনা করতে গিয়ে প্লেটো লোগোস এর কথা বলেছেন। লোগোস মানে হলো ছাঁচ। অর্থাৎ বেকারির বিস্কুটের ছাঁচের কথা কল্পনা করুন। একটা নিখুঁত ছাঁচে ফেলে বিস্কুটের শেইপ তৈরি করা হয়। কিন্তু সেই বিস্কুট পুরোপুরি প্রস্তুতের পর বিস্কুটের ছাঁচের মতো নিখুঁত আকৃতি লাভ করতে পারে না, কোনো না কোনো খুঁত থেকেই যায়।
সৃষ্টি হিসেবে আমরা মানুষরাও নিখুঁত নই। প্লেটোর মতে প্রত্যেক সৃষ্টির পেছনে আছে একেকটা লোগোস। অর্থাৎ একটা নিখুঁত লোগোস থেকেই বাকিদের সৃষ্টি করা হয়েছে। আমরা বলতে পারি, প্রত্যেক মানুষের সৃষ্টি হয়েছে একটা নিখুঁত মানুষ, অর্থাৎ লোগোস থেকে। ঠিক তেমনি প্রত্যেক মোরগ সৃষ্টির পেছনে আছে একটা নিখুঁত মোরগের লোগোস। প্লেটোর মতে লোগোস নিখুঁত বলেই তা সত্য, আর সৃষ্ট বাকিসবকিছুর অবস্থান সত্য থেকে তিনহাত দূরে। অর্থাৎ প্লেটোর মতে লোগোস থেকে সৃষ্ট দৃশ্যমান জগতটা আসলে প্রকৃত সত্য নয়।
তাহলে সত্য আসলে কী? লোগোসের সরূপই বা কেমন। এর উদাহরণ প্লেটো দিয়েছেন খুব চমকপ্রদভাবে। ধরুন একজন মানুষকে একটা অন্ধকার গুহায় আটকে রাখা হয়েছে, যে কখনো মানুষ দেখে নি। সে মাঝেমাঝে বাইরে থেকে আসা আলোতে গুহার দেয়ালে তৈরি হওয়া মানুষের ছায়া দেখতে পায়। এখন সেই বন্দী মানুষটি যেহেতু কখনো সত্যিকারের মানুষ দেখে নি, তাই সে মানুষের তৈরি হওয়া ছায়াকেই সত্যিকারের মানুষ মনে করে। প্লেটোর মতে, আমরাও ঠিক গুহায় আটকে থাকা মানুষের মতো। আমরা যেহেতু সত্যিকারের লোগোস দেখি নি, তাই চর্মচক্ষুর দৃশ্যমান জগতকে সত্য ভেবে ভুল করি।
প্লেটো যেহেতু বাস্তব জগতের চাইতে আইডিয়াল ওয়ার্ল্ড কিম্বা ভাবের জগতকে বেশি সত্য মনে করতেন- তাই প্লেটোকে বলা হয়ে থাকে ভাববাদী দার্শনিক। প্লেটোর ভাববাদ আগ্রাসী প্রভাব বিস্তার করেছে সমগ্র ধর্মদর্শনে, পুরোটা মধ্যযুগ জুড়ে। খ্রিস্টান ভাববাদ, মুসলিম সুফিবাদী চিন্তা, হিন্দু বেদান্ত দর্শন কিম্বা ইবনুল আরাবীর ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’, এর সবগুলোতেই প্লেটোর চিন্তা ও দর্শন সুবিশাল প্রভাব বিস্তার করে গেছে।