পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহকে নিয়ে একটা সিনেমা তৈরি করা হয়েছে ১৯৯৮ সালে। পুরোটা ইংরেজি ভাষায়। এ যেন একজন সেক্যুলার মানবতাবাদীর মুসলিম জাতীয়তাবাদী হয়ে ওঠার গল্প। মুসলিমলীগ প্রতিষ্ঠার আগে ভারতে স্বাধীনতার নেত্রিত্ব দিতো ভারতীয় কংগ্রেস পার্টী। মহাত্মা গান্ধী ভারতের স্বাধীকারের সিম্বল হিসেবে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন টার্ম ইউজ করতেন, যেমন ‘সত্যাগ্রহ’ ‘অহিংসা’ ইত্যাদি। যে ব্যাপারটা জিন্নাহ পছন্দ করতেন না। ভারত অসংখ্য ধর্ম-বর্ণ আর মতের দেশ। কিন্তু হিন্দুরা প্রবলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো। তাই ভয় ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে সংখ্যালঘুদের নির্যাতিত হবার। তাই এই বহুধর্ম আর জাতির দেশের স্বাধীনতার নেত্রিত্বদানকারী রাজনৈতিক দলটি হিন্দুত্ববাদী হয়ে উঠুক এটা জিন্নাহ চাইতেন না। গান্ধী কিম্বা জওহরলাল নেহেরুর মতো উদার নেত্রিত্বের বাইরেও কংগ্রেসের ভেতরে একটি শক্তিশালী হিন্দুত্ববাদী সমর্থকশ্রেণি ও ভাবধারা বিদ্যমান ছিলো। তাই রাজনীতিতে গান্ধীর হিন্দুধর্মীয় রেটোরিকের ব্যবহার জিন্নাহকে ভারতের মুসলিমদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংকীত করে তুলেছিলো। তিনি কংগ্রেস থেকে ইস্তফা দিয়ে মুসলিম লীগে যোগ দিলেন।

জিন্নাহ বলতেন, যখন বৃহৎ রাজনৈতিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠের ইস্যুকে সার্ভ করার হাতিয়ার হয়ে যায়- তখন সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভিন্ন নেত্রিত্বের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়৷ জিন্নাহর সংশয় অমূলক ছিলো না। ব্রিটিশ আমলেই ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলো জিন্নাহকে বারবার সংকীত করে তুলেছিলো। তিনি মুসলিমদের হিন্দুত্ববাদী নির্যাতনের থেকে বাঁচানোর তাগিদে মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর স্বপ্নের পাকিস্তানের ব্যর্থতার অনেক কারণ এবং একাডেমিক সমালোচনা আমলে নিয়েও একথা জোর দিয়ে বলা যায়- তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ছিলো অবভিয়াস।
জিন্নাহ যা নিয়ে ভয় পেতেন তা-ই আমরা বর্তমান ভারতে ঘটতে দেখছি। ভারতের সাম্প্রদায়িক শক্তি সেদেশে প্রবলভাবে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। ভারতীয় জনগণের মাঝেও সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি আশংকাজনকহারে বাড়ছে। গুজরাট রায়টের সময় ক্ষমতাসীন সেক্যুলার কংগ্রেসের নিরব ভূমিকা মুসলিম জনমনে অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বাবরী মসজিদের ধ্বংসসাধন করে সেখানে রামমন্দির স্থাপনের জল্পনাকে ভারতীয় সেক্যুলার সরকার আর তাদের আদালত পরোক্ষভাবে অনুমোদন দিয়ে গেছে।

গত কয়েক বছর ধরে ভারতে ‘দিল্লির মসনদে’ সমাসীন হয়ে আছে গুজরাট রায়টের খলনায়কেরা। তাদের ক্ষমতায় আরোহনের পর থেকে ভারতে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ বেড়েছে বহুগুণ। গরুর মাংস বহনের অভিযোগে এই পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে অসংখ্য মুসলিমকে। ঝাড়খন্ডের মুসলিম যুবক আনসারীকে টানা আঠারো ঘন্টা পিটিয়ে জোর করে ‘জ্যায় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করা হয়েছে। শুধু কাশ্মীর নয়, বর্তমানে গোটা ভারতই পরিণত হয়েছে হিন্দুত্ববাদের আঁতুড়ঘরে। উগ্র হিন্দুত্ববাদের সম্ভাব্য উত্থান নিয়ে জিন্নাহর সেদিনের সেই সংকীত হওয়া যে মোটেই অমূলক ছিলো না- তা আজ প্রমাণিত। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধী জ্ঞাত ছিলেন, তাই তিনি মেনে নিয়েছিলেন মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহর পাকিস্তানের দাবী। এই মেনে নেয়ার শাস্তি পেতে গান্ধীকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি, ভারত স্বাধীন হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি খুন হয়েছিলেন উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও কট্টর ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নাথুরাম গডসে’র হাতে। ধারণা করা হয় নাথুরাম গডসে হিন্দুত্ববাদী আরএসএস’র সদস্য ছিলেন।
যাহোক, সারা পৃথিবীতেই উঠে আসা উচিৎ এমন নেত্রিত্ব যারা সংখ্যাগরিষ্ঠের লেজুড়বৃত্তি নয় বরং সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হবে। তবে সেই অধিকার চেতনায় সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, থাকবে মানবিকতা আর ন্যায়-বিচারের বোধ। শুধু স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার অধিকারই না, যাতে করে সকল রাজনৈতিক ভিন্নমত চর্চার অধিকার নিশ্চিত হয়- তার জন্য জিন্নাহর মতো ডাইনামিক নেত্রিত্বের উঠে আসাটা জরুরী, বিশেষ করে ফ্যাসিবাদী বাংলাদেশ কিম্বা হিন্দুত্ববাদী ভারতের মতো রাষ্ট্রে, যেখানে ভিন্নমত চর্চার স্পেইস দিনদিন সংকুচিত হয়ে আসছে।