বিশ্বাস দুই ধরণের। একটা হলো যৌক্তিক বিশ্বাস, অন্যটা অন্ধ বিশ্বাস। তবে পুরোপুরি অন্ধবিশ্বাস কখনো টিকে থাকতে পারে না। অন্ধবিশ্বাসগুলো কালের প্রবাহে হারিয়ে যায়। কিন্তু, দুর্বল যুক্তির উপরে ভর করে কিছু অন্ধবিশ্বাস টিকে থাকে।
যুক্তি বা কুযুক্তির জ্ঞান আমরা পাই আমাদের চেতনা থেকে। তাই যার চেতনা কিম্বা যুক্তি-বুদ্ধি প্রয়োগের সক্ষমতা থাকে না, তাকে আমরা বলি অচেতন। বিশ্বাস হলো যুক্তির উপরি পর্যায়। যুক্তির এন্ড রেজাল্ট হলো বিশ্বাস। মহামতি প্লেটো জ্ঞানের সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে বলেছেন- “Knowledge is justified true belief.” অর্থাৎ, জ্ঞান হলো যাচাইকৃত সত্য বিশ্বাস।

তাই, একজন জ্ঞানীকেও বিশ্বাস করতে হয়। কিন্তু জ্ঞানী যাচাইহীন ভাবে বিশ্বাস করে না। যাচাইয়ের মানদন্ড ঠিক হয় মানুষের ভেতরকার চেতনাবোধ থেকে। এই চেতনাবোধের অব্জেক্টিভিটি থাকার কারণেই কোনোকিছু সার্বজনীন জ্ঞান হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আমরা একই সাথে চেতনাবোধের সাব্জেটিভিটিও দেখতে পাই। তাই মানুষের ইন্টেনশনালিটিতে বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে সামাজিক বিজ্ঞানগুলো যুক্তি এবং তথ্য নির্ভরতার পাশাপাশি অনেকটাই ব্যক্তি/সমাজ/সংস্কৃতি নির্ভরও বটে। এক্ষেত্রে বলা যায়- Justified true information + Subjective belief = Knowledge
যাহোক, আমরা টপিকে ফিরি। আমরা বিশ্বস্ত মানুষকেই সাধারণত বিশ্বাস করি। কিন্তু বিশ্বস্ততা যাচাইয়ের বিষয়। বিশ্বস্ত ব্যক্তির বক্তব্য আমরা অনেকক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় মেনে নিই। আবার সাম্প্রতিক তথ্যহীনতা কিম্বা জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে যাচাইকৃত বিশ্বস্ত ব্যক্তিও একটা পর্যায়ে ভুল বক্তব্য কিম্বা পরামর্শ দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে পুনর্যাচাইয়েরও প্রয়োজন পড়ে। তাই জ্ঞানের চর্চা করে যেতে হয় আমৃত্যু।
কিন্তু তাই বলে সত্যকে খুঁজে ফেরার এই জার্নিতে নির্দিষ্ট সত্য বলে যে কিছু নেই- ব্যাপারটা তা নয়। সত্য নির্দিষ্ট, কিন্তু সত্যের বিভিন্ন লেয়ার, পথ ও পদ্ধতি থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে সেসব পথ ও পদ্ধতি কখনোই পরস্পর বিরোধী কিম্বা সাংঘর্ষিক কিছু হবে না। মানুষের যুক্তিবোধই এসব আপাত সংঘাতকে ডিটেক্ট করতে পারে।
যুক্তির বাইরে কিছু নেই। থাকতে পারে কিছু দুর্বল যুক্তি, কিছু কু-যুক্তি, কিন্তু সেসবও যুক্তি। মানুষ যুক্তির বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। যেসব সিদ্ধান্ত মানুষ নিরেট আবেগের বশবর্তী হয়ে নেয় বলে মনে হয়- সেসব সিদ্ধান্তেও অবচেতন মনের যুক্তিবোধ কার্যকর থাকে। যাকিছু আপাতত যুক্তির উর্ধ্বে মনে হয়- সেসবেও উচ্চস্তরের যুক্তি থাকে। আমাদের অক্ষমতার কারণে অনেক কিছুর যৌক্তিকতা বোধগম্য হয় না, তার মানে এই না যে, সেসব অযৌক্তিক! আনপড় একজনকে তো গাণিতিক যুক্তি বুঝিয়ে লাভ নেই। তাকে তার মতো করে বোঝাতে হবে।
যাহোক, যুক্তিহীনতা অন্ধবিশ্বাসের জন্মদাতা। তাই আসুন, স্ব-স্ব জায়গা থেকে যৌক্তির বিশ্বাস গড়ে তুলি।