ই-লার্নিং বা অনলাইন লার্নিংয়ের পথচলা কম সময়ের নয়। আজকাল বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষ অনলাইনে পড়াশোনা করছে। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, একটা স্টুডেন্ট ক্লাসে বসে লেকচার নোট নিয়ে যতটুকু শিখতে পারে, তার চাইতে ঢের বেশি শিখতে পারে অনলাইনে। ই-লার্নিং যেহেতু সেল্ফ-মোটিভেটেড লার্নিং, এখানে একজন নিজের সময়-সুযোগ মতো পড়াশোনা করতে পারে।
আজ আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের (4th Industrial Revolution) কথা বলছি, অথচ বাংলাদেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় উপযুক্ত শিক্ষা-ক্যারিকুলাম সৃষ্টিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। সনাতনী শিক্ষা ব্যবস্থার দরুন না তৈরি হচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদ, না অর্জিত হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযুক্ত প্রস্তুতি। অনেক টাকা খরচ করে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়েও উপযুক্ত এবং যুগোপযোগী জ্ঞান ও দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে পারছে না আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা। একটা উদাহরণ দিই; বিশ্বব্যাপী আজ মার্কেটিং মানেই কিন্তু অনলাইন/ডিজিটাল মার্কেটিং, অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজ পর্যন্ত ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ওপর কোনো কোর্স চালু হয়নি।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI), ইন্টারনেট অব থিংস (IoT), মেশিন-লার্নিং (machine learning) কিম্বা মাস-অটোমেশনের (mass automation) মতো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর চর্চা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হয় না বললেই চলে। উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা-ই পড়ানো হচ্ছে, সেসব বিষয়েও আছে দক্ষ শিক্ষকের অভাব। এভাবেই চলছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা।
তবে ই-লার্নিং সুযোগ করে দিয়েছে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের৷ কোর্সেরা (coursera), উডেমি (udemy), ইডেক্স (edX) কিম্বা লিংকডইন লার্নিং (LinkedIn Learning)-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে বিশ্বমানের শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ। এখানে ক্লাস নেন বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা। অসংখ্য কুইজ (quizzes), এসাইনমেন্ট (assignment) আর এসেসমেন্টে (assessment) অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আত্মস্থ করতে পারে তার প্রয়োজনীয় নলেজটুকু৷ তাছাড়া গুগলও দিচ্ছে অনলাইন সার্টিফিকেট কোর্সে অংশগ্রহণের সুযোগ। Google Digital Garage থেকে চাইলেই যে কেউ ‘The Fundamentals of Digital Marketing’ কোর্সটি করতে পারে, আর অর্জন করতে পারে ভেরিফাইড সার্টিফিকেট।
চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে এমন একটা সময় হয়তো আসবে, যখন আমাদের প্রচলিত ট্রেডিশনাল বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা স্কুলিং সিস্টেম আর থাকবে না, শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞান ও দক্ষতার বিকাশ ঘটাবে ই-লার্নিংয়ের মাধ্যমে৷ এতে করে খরচ আর সময় দু-টোই আরও ইফেক্টিভলি ইউটিলাইজ করা সম্ভব হবে। সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়। বাংলাদেশে যদিও এখনো ই-লার্নিংয়ের ধারণা ততটা জনপ্রিয় নয়; কিন্তু দিনদিন যে এর জনপ্রিয়তা বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিশ্বব্যাপী যখন ই-লার্নিংয়ের জয়জয়কার, আমরা বাংলাদেশে খুবই পিছিয়ে আছি বলা চলে। আমাদের ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম খুবই অপ্রতুল। আয়মান সাদিক তার টেন মিনিট স্কুল-এর মাধ্যমে বাংলাদেশে অনলাইন শিক্ষাকে অনেকটাই সহজলভ্য করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যেভাবে উপকৃত হচ্ছে, একইভাবে যারা বিভিন্ন কর্পোরেট এবং লাইফ-স্কিল শিখতে চায়, তারাও উপকৃত হচ্ছে।
ই-লার্নিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ Mass Open Online Courses (MOOC)-এর আদলে কোর্স ডিজাইন করা কিংবা প্ল্যাটফর্ম রেডি করা—এসবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান আজও যোজন যোজন পিছিয়ে। বিশ্বের নামকরা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে Coursera, Udemy, edX ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের MOOC প্রকল্পের অধীনে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ আজও যোজন যোজন দূরত্ব নিয়ে পেছনেই পড়ে আছে।
MOOC হলো এমন এক প্রকল্প, যেখানে কোনো প্রকার কঠিন ধরাবাঁধা নিয়ম ব্যতিরেকেই একজন শিক্ষার্থী তার পছন্দমতো কোর্স করার সুযোগ পায় এবং উক্ত কোর্সগুলো শেষ করে সার্টিফিকেট অর্জন করে। এতে করে শিক্ষার্থীরা যেমন নিজের পছন্দের বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ পায়, তেমনি শিক্ষা হয়ে ওঠে আনন্দময়। আর প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পাওয়ায় তারা জব মার্কেটের জন্য হয়ে উঠতে পারে দক্ষ জনশক্তি।
তবে আশার দিক হচ্ছে, অনেক দেরিতে এবং অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে হলেও বাংলাদেশে এখন গড়ে উঠছে ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম। বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি ডিভিশনের অধীন Aspire to Innovate (a2i)-এর উদ্যোগে ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ‘মুক্তপাঠ’ তাদের যাত্রা শুরু করেছে। ‘মুক্তপাঠ’ ইতোমধ্যেই ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রথমবারের মতো বাংলাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে চালু করেছে ই-লার্নিং কার্যক্রম। তারা আপাতত ‘ডিজিটাল লার্নিং ডিজাইন’ এবং ‘সাইবার সিকিউরিটি’ নামে দুটো কোর্স চালু করেছে।
ঢাকার পাশাপাশি অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতেও কিছুকিছু প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন অনলাইন কোর্সের পাশাপাশি ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে, যা আমাদেরকে ক্রমেই আশান্বিত করছে। আমরা আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা শিক্ষার্থীরা দেশীয় বিভিন্ন ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নিজেদের প্রয়োজনীয় দক্ষতাটুকু অর্জনের সুযোগ পাবে এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যোগ্য হয়ে উঠবে।
কিছু দেশি-বিদেশি জনপ্রিয় ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মের ওয়েব-ঠিকানা :